আল্লাহর পথে আহ্বান

মানুষকে ন্যায়সঙ্গতভাবে হেকমত অবলম্বন করে ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে খোদার রাহে, হেদায়াতের পথে আহ্বান করার কথা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা বলেছেন। এ ব্যাপারে সূরা নাহলের ১২৫ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে, ‘আপনি হেকমত ও উত্তম কথামালার দ্বারা মানুষদের প্রতিপালকের রাহে আহ্বান করুন।’ নবী-রাসূলরা আর আসবেন না উম্মাহকে এ পথে আহ্বান করার জন্য। বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর মাধ্যমে নবী আগমনের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। তবে এ কাজের জিম্মাদারি কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী আমাদের ওপর বর্তায়। কেননা বিশ্বমানবতার মুক্তির দিশারী মহাগ্রন্থ কুরআনে ‘কুনতুম খাইরা উম্মাতিন’ আয়াতাংশে আমাদেরকে শ্রেষ্ঠ উম্মাহ বা জাতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। আর এই শ্রেষ্ঠত্বের পেছনে রয়েছে ‘আমর বিল মারুফ, নাহি আনিল মুনকার’ তথা সৎ কাজের আদেশ আর অসৎ কাজের নিষেধ করা। দাওয়াতে তাবলিগ যা প্রত্যেক নবী-রাসূলের আগমনের মূল ল্য। একমাত্র এর দ্বারাই পারি আমরা আমাদের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে।
বিশ্বখ্যাত ইসলামি বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দের আল্লামা শাহ ইলিয়াস রহ: কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত তাবলিগ জামাতের ল্য-উদ্দেশ্য হচ্ছে কিভাবে প্রিয়নবী সা:-এর প্রত্যেক উম্মতকে আল্লাহওয়ালা বানানো যায়। কিভাবে মুসলিম জাতিকে তাকওয়াওয়ালা বাননো যায়, নামাজি বানানো যায় ইত্যাদি। তাই বছরে একবার সম্মিলিতভাবে বিশ্বের সব মুসলিম উম্মাহকে নিয়ে ঈমানি মুজাকারা করার মানসে তুরাগপাড়ে বসে বিশ্ব মুসলিমদের মিলনমেলা। বিশ্ব ইজতেমার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ুক সারা বিশ্বে হেদায়াতের হাওয়া। বিশ্ব ইজতেমা তাবলিগ জামাতের বার্ষিক বৈশ্বিক সমাবেশ, যা বাংলাদেশের টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। তাবলিগ জামাতের এই সমাবেশটি বিশ্বে সর্ববৃহৎ এবং এতে অংশগ্রহণ করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা। বিশ্ব ইজতেমা শব্দটি বাংলা ও আরবি শব্দের মিশ্রণে সৃষ্ট। আরবি ‘ইজতেমা’ শব্দের অর্থ সম্মিলন, সভা বা সমাবেশ। সাধারণত প্রতি বছর শীতকালে এই সমাবেশের আয়োজন করা হয়ে থাকে; এ জন্য ডিসেম্বর বা জানুয়ারি মাসকে বেছে নেয়া হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে প্রতি বছর এই সমাবেশ নিয়মিত আয়োজিত হয়ে আসছে। বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে ঢাকার রমনা পার্ক সংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে তাবলিগ জামাতের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন বা ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৪৮ সালে  চট্টগ্রামের তৎকালীন হাজী ক্যাম্পে ইজতেমা হয়, ১৯৫৮ সালে বর্তমান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়। তখন এটা কেবল ইজতেমা হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রতি বছর ইজতেমায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর পাগার গ্রামের খোলা মাঠে ইজতেমার আয়োজন করা হয়। ওই বছর স্বাগতিক বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা অংশ নেয়ায় ‘বিশ্ব ইজতেমা’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৬৭ সাল থেকে বর্তমান অবধি ‘বিশ্ব ইজতেমা’ টঙ্গীর কহর দরিয়া খ্যাত তুরাগ নদীর উত্তর-পূর্ব তীরসংলগ্ন ডোবা-নালা, উঁচু-নিচু মিলিয়ে রাজউকের হুকুমে প্রাপ্ত ১৬০ একর জায়গার বিশাল খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রাম-শহর-বন্দর থেকে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান এবং বিশ্বের প্রায় ৫০ থেকে ৫৫টি দেশের তাবলিগি দ্বীনদার মুসলমান জামাতসহ ২৫ থেকে ৩০ লাধিক মুসল্লি আন্তর্জাতিক ইসলামি মহাসম্মেলন বা বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নেন। ১
৯২৭ সালে মাওলানা ইলিয়াস রহ: ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহরানপুর এলাকায় ইসলামি দাওয়াত তথা তাবলিগের প্রবর্তন করেন এবং একই সাথে এলাকাভিত্তিক সম্মিলন বা ইজতেমারও আয়োজন করেন। বাংলাদেশে ১৯৫০-এর দশকে তাবলিগ জামাতের প্রচলন করেন মাওলানা আবদুল আজিজ। বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় মারকাজ বা প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদ থেকে এই সমাবেশ কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়। পুরো সমাবেশের আয়োজনই করে থাকেন একঝাঁক ধর্মপ্রাণ মুসলমান স্বেচ্ছাসেবক। যারা আর্থিক, শারীরিক সহায়তা দিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এই সমাবেশকে সফল করতে সচেষ্ট থাকেন।
পুরো সমাবেশস্থলটি একটি উন্মুক্ত মাঠ, যা বাঁশের খুঁটির ওপর চটের ছাউনি দিয়ে সমাবেশের জন্য প্রস্তুত করা হয়। শুধু বিদেশী মেহমানদের জন্য টিনের ছাউনি ও টিনের বেড়ার ব্যবস্থা করা হয়। সমাবেশস্থলটি প্রথমে খিত্তা ও পরে খুঁটি নম্বর দিয়ে ভাগ করা হয়। অংশগ্রহণকারীরা খিত্তা নম্বর ও খুঁটি নম্বর দিয়ে নিজেদের অবস্থান শনাক্ত করেন। তা ছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলাওয়ারি মাঠের বিভিন্ন অংশ ভাগ করা থাকে। বিদেশী মেহমানদের জন্য আলাদা নিরাপত্তাবেষ্টনী সমৃদ্ধ এলাকা থাকে, সেখানে স্বেচ্ছাসেবকেরাই কঠোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন, কোনো সশস্ত্রবাহিনীর অনুপ্রবেশের অধিকার দেয়া হয় না।
সাধারণত তাবলিগ জামাতে অংশগ্রহণকারীরা সর্বনিম্নœ তিন দিন আল্লাহর পথে কাটানোর নিয়ত বা মনোবাঞ্ছা পোষণ করেন। সে হিসেবেই প্রতি বছর বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনজুড়ে। সাধারণত প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শুক্রবার আমবয়ান ও বাদ জুমা থেকে বিশ্ব ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। তবে এ বছর ৯ জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে। প্রতি বছরই এই সমাবেশে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বিশ্ব ইজতেমা প্রতি বছর দুইবারে করার সিদ্ধান্ত নেয় কাকরাইল মসজিদ কর্তৃপ। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সাল থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় এবং তিন দিন করে আলাদা সময়ে মোট ছয় দিন এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ আমবয়ান বা উন্মুক্ত বয়ানের মাধ্যমে শুরু হয় এবং আখেরি মোনাজাত বা সমাপনী প্রার্থনার মাধ্যমে শেষ হয়।