শয়তান কী ?

আক্বীদার ক্ষেত্রে এটি একটি মৌলিক প্রশ্ন যে, শয়তান মূলত কী? বাস্তব কোনো বস্তু না রূপক কিছু? না মন্দ চিন্তা আর কুমন্ত্রণাই শুধু। যেমন অনেকের ধারণা। না জীবানু, যেমন অন্য অনেকের ধারণা। না মন্দের প্রতীকী চরিত্র? আলোচনার স্বার্থে আমরা একে মন্দের প্রতীকই ধরে নেব।
এ ব্যাপারে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা কী?
আমাদের আক্বীদা, শয়তান (বাস্তব) ও সে জিন-জাতির অন্তর্ভুক্ত। যেমন আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেনঃ
﴿ وَإِذۡ قُلۡنَا لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ ٱسۡجُدُواْ لِأٓدَمَ فَسَجَدُوٓاْ إِلَّآ إِبۡلِيسَ كَانَ مِنَ ٱلۡجِنِّ فَفَسَقَ عَنۡ أَمۡرِ رَبِّهِۦٓۗ﴾ [الكهف: ٥٠] 
‘‘আর স্মরণ কর, আমি যখন ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, ‘আদমকে সিজদা কর’, তখন সকলেই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত; সে জিনদেরই একজন। সে তার প্রতিপালকের আদেশ অমান্য করল।’’ (সূরা আল-কাহাফ : ৫০)
তাই, আমরা জিন-ইনসানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করি। আর শয়তান জিনের প্রকারভুক্ত এবং তারা প্রত্যেকটি মানুষের সাথে রয়েছে।
ইমাম মুসলিম রহ. সূত্রে ইবনে মাসউদ রা. বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বাণী একথার স্বপক্ষে প্রমাণ-
«وَمَامِنْكُمْ مِنْ أحَدٍ إلاَّ وَقَدْ وُكِلَ قَرِيْنُهُ مِنَ الْجِنِّ وَقَرِيْنُهُ مِنَ الملَائِكَةِ، قالوا: وإياك يا رسول الله؟ قال: وَإيّاي، ولكِنَّ الله َ عز و جل- أَعَانَنِيْ  عَلَيْهِ، فَلَا يَأمُرُنِي إلا بِحَقٍّ». (رواه مسلم في صفات المنافقين، برقم : ২৮১৪)
‘‘তোমাদের প্রত্যেকের সাথেই জিন ও ফিরিশতাদের মধ্য হতে একজন একজন করে সঙ্গী নির্ধারণ করা হয়েছে’’। সাহাবায়ে কেরাম আরজ করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার সাথেও কী?
বললেন, ‘‘হাঁ আমার সাথেও। তবে মহান আল্লাহ আমাকে তার বিরুদ্ধে জয়ী করেছেন। তাই সে আমাকে কেবল হকেরই নির্দেশ দেয়।’’ (বর্ণনায়ঃ মুসলিম, হাদীস নং ২৮১৪)
তাহলে বোঝা গেল, প্রত্যেকের সাথেই একজন করে জিন সঙ্গী রয়েছে। (যে তাকে কুমন্ত্রণা দেয়) এমনকি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথেও। তবে তাঁর সঙ্গীর বিরুদ্ধে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে জয়ী করেছেন। তাই সে তাঁকে একমাত্র হকের নির্দেশ দেয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-
﴿ قُلۡ أَعُوذُ بِرَبِّ ٱلنَّاسِ ١ مَلِكِ ٱلنَّاسِ ٢ إِلَٰهِ ٱلنَّاسِ ٣ مِن شَرِّ ٱلۡوَسۡوَاسِ ٱلۡخَنَّاسِ ٤ ٱلَّذِي يُوَسۡوِسُ فِي صُدُورِ لنَّاسِ ٥ مِنَ ٱلۡجِنَّةِ وَٱلنَّاسِ 6 ﴾ [الناس: ١،  ٦] 
‘‘বল, আমি আশ্রয় চাচ্ছি মানুষের প্রতিপালকের, মানুষের অধিপতির, মানুষের মাবুদের কাছে; আত্মগোপনকারী কুমন্ত্রণাদাতার অনিষ্ট থেকে, যে কুমন্ত্রণা দেয় মানুষের অন্তরে, জিনের মধ্য হতে কিংবা মানুষের মধ্য হতে।’’ [সূরা আন-নাছ ১-৬]
কুমন্ত্রণা কখনো মন্দমানুষের থেকে, কখনো জীনের থেকে হয়। ‘জিন শয়তান’ ও মানুষকে কুমন্ত্রণা দেয়।
শয়তানের সন্তান-সন্ততিও আছে এরা বংশ বিস্তার করে।
﴿أَفَتَتَّخِذُونَهُۥ وَذُرِّيَّتَهُۥٓ أَوۡلِيَآءَ﴾ [الكهف: ٥٠] 
‘‘তবে কি তোমরা শয়তানকে এবং তার বংশধরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করছ?’’ (সূরা আল-কাহাফ : ৫০)
পার্থিব জগতে মানুষকে ভ্রষ্ট করতে শয়তানের বংশধর ও অনুসারীরা অবিরাম প্রয়াস চালাচ্ছে।

শয়তানের কৌশল

শয়তান দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি কিংবা দাওয়াতের বিষয়বস্তু উভয় ক্ষেত্রেই এমন কৌশল অবলম্বন করে, যাতে সে ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়।
ইবনুল কাইয়্যেম আল-জাওযিয়্যাহ্‌ রহ. বলেন, শয়তানের দাওয়াতের বিষয় বস্তুতে অগ্রসর হওয়ার ছয়টি ধাপ রয়েছে। এ ছয়টি ধাপে শয়তান মানুষকে আহবান জানায় কুপথে চলতে।

প্রথম ধাপ :
মানুষ শির্ক কিংবা কুফরে লিপ্ত হোক, শয়তান সর্বপ্রথম এ প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু ব্যক্তি যদি মুসলিম হয়, তাহলে সে (তাকে বিভ্রান্ত করতে) পরবর্তী ধাপ অবলম্বন করে।

দ্বিতীয় ধাপ :
‘বিদ‘আত’। ‘ব্যক্তি যদি মুসলিম হয়, তাহলে সে যেন নিজে বিদ‘আত উদ্ভাবন করে এবং এর প্রচলন করে’ দ্বিতীয় পর্যায়ে শয়তান এ-প্রয়াসই চালায়। কিন্তু ব্যক্তি যদি সুন্নতের পাবন্দ হয়, তাহলে শয়তান তৃতীয় কৌশল অবলম্বন করে।

তৃতীয় ধাপ :
‘কবীরা গুনাহ’ বড় পাপ বা নাফরমানীর স্তর। শয়তান মানুষকে কবীরা গুনাহে লিপ্ত করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যদি তাকে এসব থেকেও মুক্ত রাখেন, তবুও শয়তান হতোদ্যম হয় না। তখন সে চতুথ কৌশল অবলম্বন করে।

চতুর্থ ধাপ :
‘ছগীরা গুনাহ’, ব্যক্তিকে কবীরা গুনাহে লিপ্ত করতে না পারলে শয়তান ছগীরা গুনাহে লিপ্ত করার প্রয়াস চালায়। কিন্তু ব্যক্তি যদি এর থেকেও মুক্ত হয়, তাহলে শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করতে ভিন্ন কৌশলে লিপ্ত রাখার চেষ্টা করে। যা পরবর্তীতে দু’টি ধাপে উল্লেখিত হচ্ছে।

পঞ্চম ধাপ :
‘মুবাহ’ যা করলে ছাওয়াব নেই, না করলে গুনাহ নেই। এ ধরনের মুবাহ কাজে ব্যক্তিকে শয়তান এমনভাবে লিপ্ত রাখে যে, এতেই সে পূর্ণ সময় নিঃশেষ করে। কিন্তু যে সব জরুরী বিষয়ে আমরা আদিষ্ট, তাতে সময় দেয় না।

ষষ্ঠ ধাপ :
শয়তান মানুষকে অধিক ফযীলতের আমল থেকে বিরত রেখে, অপেক্ষাকৃত কম ফযীলতের একটা নির্দিষ্ট ভাল আমলে লিপ্ত রাখে। আর সে ব্যক্তিও উত্তম ও সুন্দরতম আমল থেকে বিরত থেকে এতেই নিবিষ্ট থাকে।
যেমন : ফরয ছেড়ে সুন্নত নিয়ে ব্যস্ত থাকা। অদ্ভুত! ফরয ছুটে যাচ্ছে অথচ সুন্নত নিয়েই ব্যস্ত!!
শয়তান কিন্তু তার দাওয়াতে তৎপর। ক্রমান্বয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে যাচ্ছে। শ্লথগতিতে উপর্যুপরি পদক্ষেপ গ্রহণের কৌশলে মানুষকে কাবু করছে সে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
﴿كُلُواْ مِمَّا رَزَقَكُمُ ٱللَّهُ وَلَا تَتَّبِعُواْ خُطُوَٰتِ ٱلشَّيۡطَٰنِۚ إِنَّهُۥ لَكُمۡ عَدُوّٞ مُّبِينٞ ١٤٢ ﴾ [الانعام: ١٤٢] 
‘‘আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে যে রিযিক দান করেছেন তা থেকে খাও এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয় সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’’ (সূরা আল-আন‘আম : ১৪২)
মানুষের পেছনে শয়তান প্রথমে অল্প-অল্প প্রচেষ্টা চালায় এবং ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে।
সকল শ্রেণীর মানুষের কাছে সে তাদের জন্য উপযোগী পন্থায় ও পদ্ধতিতে দাওয়াত দেয়। তাপসীর কাছে যায় কাছে তাপস্যের পথে, বিদ্যানের কাছে বিদ্যার পথে, অজ্ঞের কাছে যায় অজ্ঞতার পথে যায়।