বিকেল ৫টা। মহাখালী থেকে বাসে উঠলাম। একটু সামনে আসতেই রেল গেটের আগে ট্রাফিক সিগনাল। থেমে গেল বাস। প্রচণ্ড গরম। সারা দিনের সফরের কান্তি তো আছেই। বাসের বেশির ভাগ যাত্রীকেই মনে হলো সারা দিনের কাজ শেষে এই পড়ন্ত বিকেলে কান্ত হয়ে ঘরে ফিরছেন। কানে এলো আওয়াজ ‘দানকারীদের মাতা-পিতা সুখে থাকবেন কবরে; নূরের টুপি মাথায় দিয়া উঠাইবেন কাল হাশরে।’ জ্যামে গাড়ি থামতেই রসিদ বই হাতে পঞ্চাশোর্ধ বয়সের এক দাড়িওয়ালা লোক উঠলেন। শুরু হলো তার নীতিবাক্য ‘সম্মানিত যাত্রী ভাই ও বোনেরা, কত টাকা কত পয়সা কতভাবে খরচ হয়ে যায়…’।
একজন ১০ টাকা দান করলেন। লোকটি দোয়া করে দানকারীর পিতা-মাতাকে জান্নাতুল ফেরদৌসেই যেন পৌঁছে দিলেন। আরেকটু সামনে এলো লোকটি। আমার পেছনের এক ভদ্রলোক মসজিদটি কোথায় জানতে চাইলে সে বলল, ‘ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলায়’। ঝিনাইদহের মসজিদের জন্য ঢাকায় চাঁদা কেন জানতে চাইলে সে বলল, মসজিদ এলাকাতেও কালেকশন হচ্ছে। মসজিদের কাজ দ্রুত শেষ করা দরকার কিন্তু মসজিদের ছাদ দিতে অনেক টাকা প্রয়োজন। গ্রামবাসীর পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না, তাই তিনি ঢাকা এসেছেন। মসজিদের কাজ শেষ করতে কত টাকা লাগবে জানতে চাইলে লোকটি বলল, দুই লাখ টাকা প্রয়োজন। ভদ্রলোক বললেন ‘আপনাকে এভাবে কালেকশন করতে হবে না, আমি দুই লাখ টাকা দেবো’। কিন্তু এতে লোকটি যেন নাখোশ। বিরক্তির সুরে বললেন, ‘এখন যা দেবেন দিয়ে দেন’। ভদ্রলোক বললেন, ‘মসজিদ কমিটির লোকজনের ফোন নম্বর দেন। আমি এলাকার ইউপি চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করে আগামীকালই দুই লাখ টাকা দিয়ে দেবো।’ লোকটি আর কোনো কথা না বলে পেছনের দরজা দিয়ে নেমে চলে গেলেন।
ক’দিন পর টঙ্গী থেকে বাসে উঠলাম, আসছি মহাখালী। কিছুক্ষণ আসতেই বাসে উঠলেন এক বৃদ্ধ। পাশের একটি মাদরাসার ছাত্রদের জন্য কুরআন শরিফ কেনার টাকা চাইলেন যাত্রীদের কাছে। এক ভদ্রলোক কুরআন শরিফ কিনে দিতে চাইলে তিনি তাতে নারাজ। টাকা চাইলেন। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি সামনেই নামব, আপনি আমার সাথে নামুন যতখানা কুরআন শরিফই দরকার হয় আমি আপনার সাথে গিয়ে তা কিনে দিয়ে আসব।’ কোন মাদরাসার ছাত্রদের জন্য জানতে চাইলে কিছু না বলেই চলে গেল লোকটি।
রামপুরা ব্রিজ, সায়েদাবাদ মোড়, বনানী আমতলী মোড়সহ অনেক জায়গায় মাইকে মসজিদের নামে চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। কোথাও তো তা করা হয় ডিজিটাল কায়দায়। মুখে নয়, যাত্রীদের কাছে একটি করে চিরকুট ধরিয়ে দেয়া হয়। চিরকুটে থাকে চাঁদার আবেদন। ঢাকা শহরে মানুষের কর্মব্যস্ততা, আত্মমগ্নতায় কিংবা সরলতার কারণে মনে প্রশ্ন থাকলেও এদের কাছে দান করে যাচ্ছেন।
ইসলাম একান্ত প্রয়োজনেও হাতপাতাকে অপছন্দ করেছে। মসজিদে নামাজে দাঁড়িয়ে সূরা ফাতিহার শপথে বলা হয়, ‘আমারা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং তোমারই কাছে সাহায্য চাই।’
কেবল আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার শপথ করা হয় অথচ ইসলামের উপাসনালয় মসজিদ বানাতেই রাস্তায়, যানবাহনে কিংবা যেখানে-সেখানে মানুষের কাছে হাতপাতা হচ্ছে। এমনকি কখনো অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছেও পাতা হচ্ছে হাত।
পৃথিবীর ধর্মগুলোর মধ্যে ইসলামই ভিক্ষা কিংবা কারো কাছে হাতপাতার বিষয়ে সবচেয়ে কঠোর অবস্থানে। হজরত সামুরা ইবনে জানদুব রা: থেকে বর্ণিত মহানবী সা: বলেছেন, ‘ভিক্ষাবৃত্তি হলো ক্ষত স্বরূপ; এর দ্বারা মানুষ মুখমণ্ডলকে ক্ষতবিক্ষত করে’ (আবু দাউদ)। অন্য হাদিসে হজরত হাকিম ইবনে হিজাম রা: থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ওপরের হাত নিচের হাতের চেয়ে উত্তম’ (বোখারি, মুসলিম)। হাদিসের ব্যাখ্যায় ইবনে হাজার আসকালানী রহ: ফতহুল বারিতে লিখেছেন, ওপরের হাত হলো দাতার হাত আর নিচের হাতই গ্রহীতার হাত।
মদিনায় পদার্পণ করেই রাসূলুল্লাহ সা: মসজিদে নববি নির্মাণ করেন। তিন দরজাবিশিষ্ট এ মসজিদের দেয়াল ছিল কাঁচা ইটের, খুঁটি ছিল খেজুরের। সেই খেজুরগাছের খুঁটির মসজিদে নামাজ পড়তেন পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। আজ আমাদের মসজিদগুলো সুন্দর হয়েছে; কিন্তু আবুবকর, ওমর, ওসমান কিংবা আলী (রা:)-এর সেই মুসল্লি নেই। সূরা তাওবার ১৮ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে ইবনে কাসিরে এসেছে, ‘মসজিদ আবাদ বলতে শুধু এর চাকচিক্য ও সৌন্দর্যবর্ধনকেই বোঝায় না; বরং তাতে আল্লাহর আলোচনা করা, আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করা এবং মসজিদকে সব ধরনের শিরক ও পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত রাখা’ বোঝায়। ইবাদতের জন্য আরামদায়ক বানানো অথবা সৌন্দর্যবর্ধন দোষণীয় নয়। তা হবে মহল্লাবাসীর সাধ ও সাধ্যের সমন্বয়ে। মহল্লাবাসীর যতটুকু সাধ্য রয়েছে সে অনুযায়ীই মসজিদ নির্মাণ করা হবে। তার জন্য অন্য এলাকা থেকে চাঁদা সংগ্রহ করা ঠিক হবে না। যেখানে সেখানে হাত পেতে কাউকে কষ্ট দেয়া, মসজিদের নামে চাঁদাবাণিজ্য বিজ্ঞ মহলের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মসজিদের জন্য কালেকশন প্রয়োজন আছে নিশ্চয়। এভাবে চাঁদা সংগ্রহে কুরআন ও হাদিসের কোথাও কি বলা হয়েছে? সংগৃহীত চাঁদার কতটুকু ব্যয় হচ্ছে মসজিদ উন্নয়নে? দানকারীর বাবা-মাকে নূরের টুপি পরিয়ে দেয়া হবে এমনটি কি আছে কোনো হাদিসে? ইসলাম সমর্থন না করলেও কিছু লোক একে নিজেদের পেশা বানিয়ে নিয়েছে। মসজিদের চাঁদা সংগ্রহের চেয়ে যেখানে নিজেদের উপার্জনটাই বড়। সংগৃহীত টাকার কোনো হিসাব নেয়া সম্ভব হয় না। আদায়কারী যা বলেন তাই মেনে নিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। তাই তো কমিটির আগ্রহ না থাকলেও আদায়কারীর আগ্রহই থাকে বেশি। এভাবে হাতপাতার কারণে যেমন ইসলামের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে, তেমনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে দানকারীর পরিমাণও কমছে।
বিষয়টির সমাধানে মসজিদ ব্যবস্থাপনার সাথে সংশ্লিষ্টদের সচেতন হতে হবে, অন্য দিকে সাধারণ দানকারীদেরও সতর্ক হতে হবে। দানকারীরাই এরূপ কাজ বন্ধে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারেন। দান সবারই করা উচিত; কিন্তু যেখানে-সেখানে দান না করে যে মসজিদে দান করবেন সে মসজিদে দানবক্স কিংবা কর্তৃপক্ষের কাছে যদি দান করেন তাহলে এসব আদায়কারীর বাজার মন্দা হয়ে যাবে। ফলে তারা আর এ পথে আসবে না।
ইসলামের লেবাস কিংবা অনুভূতিকে পুঁজি করে এ বাণিজ্যের মাধ্যমে ইসলামকে ছোটই করা হচ্ছে। নষ্ট করা হচ্ছে ইসলামের ভাবমর্যাদা। বিদ্বেষীদের ইসলামকে ‘খয়রাতি’ বলার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের শুভবুদ্ধির উদয় হোক। বন্ধ হোক এই প্রতারণা, বন্ধ হোক মসজিদের নামে কালেকশন বাণিজ্য।
লেখক : খতিব, বায়তুল ফালাহ মসজিদ, কুষ্টিয়া