সফল মুমিনের নিজস্ব পরিচয় আছে। স্বকীয়তা আছে। আছে গুণাবলি। আল্লাহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে সফল মুমিনের বিবরণ তুলে ধরেছেন। কোথাও সফল মুমিনের পরিচয় দিয়েছেন এক কথায়। ‘যে তার আত্মাকে পবিত্র করেছে সে সফলকাম হয়েছে’ (সূরা আ’লা : ১৪)।
কোথাও আবার দীর্ঘ বর্ণনায় নানা গুণাবলি উল্লেখ করেছেন। এরূপ একটি স্থান হলো সূরা মুমিনুনের প্রথম দিকের কতগুলো আয়াত। এসব আয়াতে একজন সফল মুমিনের সম্পূর্ণ গুণাগুণ উল্লেখ করেছেন। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, এসব আয়াতে আল্লাহ সফল ও সার্থক মুমিনের পরিচয় তুলে ধরেছেন। এ আয়াতগুলো দ্বারা বিচার করা যাবে কে সফল, কে সফল নয়। আয়াতের শুরুতেই আল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘তারা, মুমিনরা সফলকাম হয়ে গেছে।’ এখানে ‘হয়ে গেছে’ অতীত ক্রিয়া ব্যবহার করেছেন। অতীতকালীন ক্রিয়া ব্যবহার কতটুকু সঙ্গত হয়েছে। অথচ এখনো তারা ওইসব গুণাবলির অধিকারি নয়। ব্যাখ্যাকারকেরা বলেন, সামনের গুণাবলির অধিকারী হলে অবশ্যই সব মানুষ সফলকাম হবে। সেই নিশ্চয়তার দিকে লক্ষ্য করে আল্লাহ অতীতকালীন শব্দ প্রয়োগ করেছেন। সার কথাÑ যদি কোনো মানুষ নি¤েœাক্ত গুণাবলির অধিকারী হতে পারেন, তাহলে তিনি অবশ্য সফল মুমিনে পরিণত হবেন। সেই নিশ্চয়তার দিকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ অতীতকালীন শব্দ প্রয়োগ করেছেন। ভবিষ্যতে নিশ্চিত বাস্তবায়িত ক্রিয়ার ক্ষেত্রে অতীতকালীন শব্দ প্রয়োগ আরবি অলঙ্কারশাস্ত্রের প্রসিদ্ধ রীতি। আয়াতগুলোতে সাতটি গুণ পাওয়া যায়।
প্রথম গুণ : ‘তারা তাদের নামাজে বিনয় নম্রতা অবলম্বন করেছে।’ প্রথম গুণ নামাজ সম্পর্কিত। নামাজে খুশু-খজু অবলম্বন করা। এর এক অর্থ হলো নামাজে স্থিরমানতা, নড়াচড়া না করা। নামাজে নড়াচড়া করা মাকরুহাতের অন্তর্ভুক্ত। কেউ কেউ আবার এ অর্থও নিয়েছেন যে, নামাজে কাপড় বা শরীর নিয়ে খেলা না করা, ইচ্ছাপূর্বক না নাড়া। বিনয় ও নম্র হওয়ার আরো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হাদিস শরিফে। মুজাহিদ বলেন, দৃষ্টি নত রাখা ও আওয়াজকে ক্ষীণ করার নাম খুশু। নামাজে বিনয় নম্র হওয়ার গুরুত্ব সীমাহীন। কেননা রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘নামাজী ব্যক্তি যতক্ষণ অন্য কিছুতে ভ্রƒক্ষেপ না করে ততক্ষণ আল্লাহ তার দিকে দৃষ্টি রাখেন।’
দ্বিতীয় গুণ : ‘তারা নিজেদেরকে অনর্থ কাজ থেকে বিরত রাখেন।’ অনর্থ অর্থবিহীন কাজ বাস্তবেও ভদ্রতার পরিপন্থী। আরবি শব্দ ‘লাগব’-এর অর্থ হলো উপকারবিহীন কাজ করা। যে কাজে কোনো সওয়াব বা উপকার নেই। একবার জনৈক সাহাবি দেখলেন একজন বালক দূরে কোথাও কঙ্কর নিক্ষেপ করছে অনর্থ, অযথা। সাহাবি তাকে নিষেধ করলেন। সে বালক শোনেনি। অতঃপর সাহাবি রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘আল্লাহর কসম যদি তুমি এ অনর্থ কাজ হতে বিরত না হও, আমি তোমার জানাজায় উপস্থিত হবো না।’ ওলামায়ে কেরাম বলেন, ‘অনর্থ কাজ থেকে বিরত থাকা ওয়াজিব। কখনো কখনো তা আমলকে নষ্ট করে দেয়। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘মানুষ যখন তার অনর্থ কাজ ছেড়ে দেয় তখন তার ইসলাম পূর্ণ হয়ে যায়।’ এ কারণে আয়াতে তা কামেল মুমিনের গুণ বলে উল্লেখ রয়েছে।
তৃতীয় গুণ : ‘তারা নিয়মিত জাকাত আদায় করে।’ জাকাত ইসলামের বুনিয়াদি বিষয়। সামর্থ্যবান ব্যক্তি যদি জাকাত আদায় না করে, তাহলে তার ইসলাম পূর্ণ হবে না। জাকাতের শাব্দিক অর্থ শুদ্ধিকরণ, পবিত্রকরণ। পরিভাষায় কিছু শর্তের মাধ্যমে সম্পদের নির্দিষ্ট অংশ দান করা। আলোচ্য আয়াতে শরিয়তের জাকাত উদ্দেশ্য হতে পারে। কুরানুল কারিমেও জাকাতের তাগিদ এসেছে। এসেছে জাকাতের বিশাল বিবরণ। জাকাত আদায় করার দ্বারা মালের পবিত্রতা রক্ষা পায়, পবিত্রতা হাসিল হয়। এর সাথে সাথে মালের মালিকের আত্মশুদ্ধি হাসিল হয়। জাকাত আদায় না করার ক্ষেত্রে রয়েছে ভয়াবহ সতর্কবাণী। হাদিসে উল্লেখ আছে, যে ব্যক্তি কার্পণ্য করে অথবা দুনিয়ার মোহে পড়ে জাকাত আদায় না করে, কাল কিয়ামতের দিন ওই মাল সাপ বানিয়ে তার গলায় পেঁচিয়ে দেয়া হবে। সেই সাপ তাকে দংশন করবে আর বলবে, ‘আমি তোমার গচ্ছিত মাল’ (বোখারি)।
চতুর্থ গুণ : ‘তারা নিজেদের লজ্জস্থান হেফাজত করে।’ মানুষের পাপের বিশাল অংশ লজ্জাস্থানের কারণে হয়। লজ্জাস্থান ব্যবহার ব্যতীত পাপের মূল পর্যায়ে পৌঁছা যায় না। কামভাব চরিতার্থ করার জন্য প্রয়োজন পড়ে লজ্জাস্থানের। তাই মহান আল্লাহ সফল মুমিনের একটি গুণ নির্ধারণ করেছেন লজ্জাস্থান হেফাজত করা। এ ছাড়া রাসূল সা: থেকে সাহল ইবনে সাদ বর্ণনা করেন; রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কাছে তার দু’চোয়ালের মধ্য অংশ (জিহ্বা) এবং দু’রানের মধ্যাংশ (লজ্জাস্থান) হেফাজতের ওয়াদা দেবে, আমি তার জান্নাতের জিম্মাদার হবো।’
পঞ্চম গুণ : ‘তারা আমানত ও অঙ্গীকার সম্পর্কে হুঁশিয়ার থাকে।’ আমানত রক্ষা করা মুমিনের জন্য ফরজ। আমানতের শাব্দিক অর্থ নিরাপদ ও হেফাজত করা। এর দ্বারা বুঝা যায় বান্দার কাছে গচ্ছিত সব বিষয়ে সে আমানত রক্ষা করা ফরজ। চাই তা হক্কুল্লাহ বা ইবাদুল্লাহ হোক। আল্লাহর হক বান্দার কাছে সব আদেশ-নিষেধ ফরজ ও ওয়াজিব। বান্দা যদি ফরজ ও ওয়াজিব পালন না করে তাহলে সে আল্লাহর দেয়া আমানত রক্ষা করল না। এমনভাবে যদি কারো গচ্ছিত মালের ব্যাপারে খিয়ানত করে। তা হলে সে আমানত রক্ষা করল না। হাদিস শরিফে আছে, যার আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই। আরো আছে, কাল কিয়ামতের দিন প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার আমানত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। এ ছাড়া রাসূলুল্লাহ সা: মুনাফিকের তিনটি আলামতের কথা বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে একটি হলো আমানত রক্ষা না করা।
ষষ্ঠ গুণ : ‘তারা অঙ্গীকার রক্ষা করে।’ অঙ্গীকার বলতে প্রথমত, দ্বিপক্ষীয় চুক্তিকে বুঝায়, যা কোনো ব্যাপারে উভয়পক্ষ ওয়াজিব করে নেয়। এরূপ অঙ্গীকার আদায় করা ফরজ। না করলে কবিরাহ গুনাহ হবে। দ্বিতীয়ত, অঙ্গীকার ওয়াদাকে বলা হয়। অর্থাৎ কাউকে কিছু দেয়ার ওয়াদা করা বা কিছু করে দেয়ার ওয়াদা করা। এটা পালন করাও শরিয়ত জরুরি করেছে। যা ওয়াজিব। হাদিস শরিফে এসেছে ওয়াদা এক প্রকার ঋণ। আর তা আদায় করা জরুরি। সুতরাং ওয়াদা পালন করাও ওয়াজিব।
সপ্তম গুণ : ‘তারা তাদের নমাজে যতœবান হয়।’ নামাজে যতœবান হওয়া মুমিনের গুণ। নামাজে যতœবান হওয়ার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো নামাজকে তারা মোস্তাহাব সময়ে আদায় করে। ফরজিয়্যাত ও ওয়াজিবাত আদায়ের সাথে সাথে সুন্নত মোস্তাহাবসহ আদায় করা।
চিন্তা করলে দেখা যাবে, উল্লিখিত গুণের মধ্যে যাবতীয় প্রকার আল্লাহর হক ও বান্দার হক হওয়ার সাথে অপরাপর বিধানাবলি প্রবিষ্ট হয়ে গেছে।