ফসলের জাকাত দেয়ার বিধান

ইসলাম বিশ্ববিজয়ী আদর্শ ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। ইসলামেই রয়েছে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানসহ ভূমিবিষয়ক সমস্যারও সমাধান। ভূমি একটি রাষ্ট্রের অপরিহার্য উপাদান। ওশোরি ভূমিতে  ওশোর দেয়া মুসলমানদের ওপর ফরজ এবং অনাদায়ে কবিরা গুনাহ।
ওশোরের পরিচয় : ওশোরকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে; যেমন
* ওশোর আরবি শব্দ, অর্থ দশমাংশ। সর্বসাধারণের সাহায্যার্থে উৎপন্ন শস্যের দশমাংশ জাকাত হিসেবে গ্রহণ করা হয় বলে তাকে ওশোর বলা হয়। 
* ওশোর বলা হয় জাকাতের মতো একটি নির্ধারিত অংশকে; যা জমির ফসলের ওপর বাধ্যতামূলক হিসেবে ধার্য করা হয় এবং ফসল থেকেই তা গ্রহণ করা হয়। 
কুরআনুল কারিমে ওশোর প্রসঙ্গ: ভূমিরাজস্ব সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন : ‘হে মুুমিনগণ! তোমরা যা উপার্জন করো এবং আমি যা ভূমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপাদন করে দেই তন্মধ্যে যা উৎকৃষ্ট তা ব্যয় করো। তার নিকৃষ্ট বস্তু ব্যয় করার সংকল্প কোরো না; অথচ তোমরা তা গ্রহণ করার নও, যদি না তোমরা চু বন্ধ করে থাকো’ (সূরা বাকারা, ২:২৬৭)। 
এ আয়াত নাজিল হওয়ার প্রেতি ও তাফসিরকারদের ব্যাখ্যায় বলা যায়, জমির ফসল কম হোক কি বেশি হোক, তার ওপর ওশোর (জাকাত) ফরজ। আয়াতটি এ কথারও দলিল যে, কেউ যদি জমি ভাড়াস্বরূপ নিয়ে চাষাবাদ করে ও ফসল ফলায় তাহলে ওশোর দেয়া কর্তব্য হবে সেই জমি চাষাবাদকারীর, জমির ফসলের মালিকের নয়Ñ যার কাছ থেকে তা ভাড়া বাবদ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু জমির মালিক ভাড়া বাবদ যে আয় পেল, সে আয় জাকাতযোগ্য হলে অবশ্যই তার জাকাত দিতে হবে। 
অপর এক আয়াতে বলা হয়েছে : ‘তিনিই আল্লাহ যিনি সৃষ্টি করেছেন মাচাবিশিষ্ট গাছের বাগানসমূহ এবং মাচাহীন গাছের বাগানসমূহ। তিনি সৃষ্টি করেছেন খেজুর গাছ ও এমন ফসলের তে, যেখানে বিভিন্ন স্বাদের ফসল উৎপন্ন হয় এবং তিনি পরস্পর সাদৃশ্যপূর্ণ ও বৈসাদৃশ্যপূর্ণ জায়তুন ও আনার সৃষ্টি করেছেন। যখন এগুলো ফলবান হয় তখন এগুলোর ফল খাও, আর ফসল তোলার দিন ফসলের হক দিয়ে দাও’ (সূরা আন ’আম, ১৪১)।
ওশোর ফরজ হওয়ার শর্তাবলি : ওশোর ফরজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে। প্রধান প্রধান শর্তাবলি নিচে উল্লেখ করা হলো :
১. মুসলমান হওয়া। কেননা ওশোরের মধ্যে মহান আল্লাহর ইবাদতের দিকটিও নিহিত। এ জন্য অমুসলমানদের ওপর ওশোর ফরজ নয়; ২. ভূমি ওশোরি হতে হবে।  ৩. ভূমি থেকে ফসল লাভ করা। কোনো কারণে ফসল উৎপাদিত না হলে ওশোর ধার্য হবে না।  ৪. ফসল এমন জিনিস হতে হবে, যা ভূমি থেকে জন্মানো ও উৎপাদন করার প্রথা রয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবেই এর চাষ করে লাভবান হওয়া যায়। আপনা থেকে উৎপন্ন কোনো ঘাস বা অপ্রয়োজনীয় গাছগাছড়া যদি কোনো ভূমিতে হয়, তবে তাতে ওশোর ধার্য হয় না। উৎপাদনের উদ্দেশ্যে যদি ঘাস ও বাঁশ জন্মানো হয় তবে তাতে ওশোর ধার্য হবে। ওশোর ফরজ হওয়ার জন্য বুদ্ধিমান ও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া শর্ত নয়। তাই মানুষের অনুকূলে ওয়াকফকৃত ভূমিতেও ওশোর ফরজ। 
কোনো লোক ব্যবসায় করার উদ্দেশ্যে ভূমি ক্রয় করে তাতে চাষাবাদ করলে ওই ভূমির উৎপাদিত ফসলের ওপরও ওশোর ফরজ হবে। ব্যবসায়ের ওপর ওশোর ফরজ হবে না। ওশোরি জমির চাষাবাদে যদি বৃষ্টি ও পুকুর বা কুয়ার পানি দিয়ে সিক্ত করা হয়, তবে বেশির ভাগের মতের ভিত্তিতে ওশোর নির্ধারিত হবে। যেমন, বৃষ্টির পানিতে বেশি সিক্ত হলে ওশোর আর পুকুর-কূপ ইত্যাদির পানিতে বেশি সিক্ত করা হলে অর্ধেক ওশোর দিতে হবে।
উৎপাদন খরচ বাবদ উৎপাদিত ফসলের এক-চতুর্থাংশ বাদ দেয়ার পর যদি তার পরিমাণ ছাব্বিশ মণ বা তার অধিক হয়, তবে ওশোর প্রদান বাধ্যতামূলক হবে। কিন্তু মুফতি মুহাম্মদ শফী র: বলেছেন, মোট উৎপাদিত ফসলের ওপরই ওশোর, অর্ধ ওশোর ওয়াজিব। চাষাবাদ, বীজ বপণ, শ্রমিক, সংরণ প্রভৃতি খরচ ওশোর আদায়ের পরই নির্ধারণ করতে হবে। ওশোরের সাথে এসব খরচের কোনো সম্পর্ক নেই। 
ওশোরের হার : ওশোরের হার প্রসঙ্গে মহানবী সা: বলেছেন, ‘যেসব ভূমি বৃষ্টি ও ঝরনার পানি দ্বারা অথবা নদ-নদী দ্বারা স্বাভাবিকভাবে সিঞ্চিত হয়, তাতে ওশোর (দশমাংশ) ধার্য হবে। আর যেসব ভূমিতে পানিসেচ করতে হয় তাতে অর্ধ ওশোরÑ বিশ ভাগের এক ভাগ ধার্য হবে’ (বুখারি, তিরমিজি)।
যদি কোনো ফসল কিছুটা সেচ এবং কিছুটা বৃষ্টি অথবা নদীর পানি দ্বারা উৎপন্ন হয়, তবে অনুমান করে দেখতে হবে কোনোটার পরিমাণ বেশি। বৃষ্টি অথবা নদীর পানির পরিমাণ যদি বেশি হয়ে থাকে তবে এক-দশমাংশ ওশোর ধার্য হবে। আর যদি সেচের পরিমাণ বেশি হয়ে থাকে তবে অর্ধ ওশোর ধার্য হবে।
ওশোরের নিসাব : ওশোর একপ্রকার জাকাত। জাকাতের হুকুম যেমন কুরআন ও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, তেমনি ওশোরের হুকুমও কুরআন-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। তবে কী পরিমাণ ফল ও ফসলে এবং কোন ধরনের ফল ও ফসলের ওশের প্রদান করতে হবে এ বিষয়ে আলিমগণের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। 
ইমাম আবু হানিফা র: উৎপন্ন ফসলের কোনো নিসাব স্বীকার করেননি। তাঁর মত অনুসারে যেকোনো ফল, ফসল বা শাকসবজি যে পরিমাণই উৎপাদিত হোক, তা থেকে ওশোর প্রদান করতে হবে। 
ইমাম মালিক, ইমাম শাফি‘ঈ, ইমাম আহমাদ এবং হানাফি মাজহাবের দুইজন ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ র: ‘ওশোর’ ধার্য হওয়ার জন্য ফসলের পরিমাণে নিসাবের শর্ত আরোপ করেছেন। এই নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে পাঁচ ‘অসাক’ (২৮ থেকে ৩০ মণের কাছাকাছি)Ñ যেসব ফসল অসাক হিসেবে পরিমাপ করা হয়। আর যা অসাক হিসেবে পরিমাপ করা হয় না, তাতে পাঁচ প্যাকেট বা পাঁচ বস্তা গণ্য করা হবে : তুলা পাঁচ বাণ্ডিল, প্রতিটি বাণ্ডিলে তিন শত মণ আর জাফরান পাঁচ মণ। এ মতটি অধিক গ্রহণযোগ্য। 
ওশোর ব্যয়ের খাত : কুরআনুল কারিমে জাকাত ব্যয়ের যে আটটি খাত বর্ণিত হয়েছে, ওশোর ব্যয়ের খাতও সেই আটটিই। কুরআনুল কারিমের ভাষায় :
‘সদকা তো কেবল নিঃস্ব, অভাবগ্রস্ত ও তৎসংশিষ্ট কর্মচারীদের জন্য, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা হয় তাদের জন্য, দাসমুক্তির জন্য, ঋণে ভারাক্রান্তদের জন্য, আলাহর পথে ও মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’ (সূরা তাওবা-৬০)। 
সুতরাং খাতগুলো হচ্ছে ১.ফকির বা দরিদ্রগণ, ২. মিসকিনগণ; ৩. জাকাত বিভাগের কর্মচারী; ৪. জাদের মণ (ইসলামের প্রতি) আসক্ত; ৫. ক্রীতদাস ও বন্দিমুক্তি; ৬. ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ; ৭. আল্লাহর পথে ও ৮. মুসাফির তথা পথিক প্রবাসী।
ওশোর ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য : ওশোর ও জাকাতের মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে, যা নি¤œœরূপ : 
১. জাকাত হলো প্রধানত গরিব ও দুস্থদের সাহায্যার্থে একজন মুসলমান কর্তৃক তার জাকাত আরোপযোগ্য সম্পদের একটি অংশ ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে প্রদান করা। অপর দিকে ওশোর হলো প্রধানত গরিব ও দুস্থদের সাহায্যার্থে একজন মুসলমান কর্তৃক তার উৎপাদিত কৃষিপণ্য থেকে শতকরা দশ ভাগ (ত্রেবিশেষে শতকরা পাঁচ ভাগ) ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে প্রদান করা। 
২. জাকাত আদায় করার জন্য এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত, কিন্তু ওশোর আদায় করার জন্য তা শর্ত নয়। উৎপাদিত ফসল কেটে তোলামাত্র ওশোর আদায় করা ফরজ। 
৩. সোনা-রূপা, ব্যবসায়িক পণ্য ও নগদ অর্থের বছরে একবার মাত্র জাকাত দিতে হয়, কিন্তু বছরে যদি কয়েকবার ফসল উৎপাদিত হয়, তাহলে প্রতিবারই আলাদা আলাদাভাবে ফসলের জাকাত বাবদ ওশোর আদায় করতে হবে। 
৪. জাকাত ফরজ হওয়ার জন্য সম্পদের মালিক হওয়া শর্ত, কিন্তু ওশোর ফরজ হওয়ার জন্য ভূমির মালিক হওয়া শর্ত নয়, ফসলের মালিক হওয়াই যথেষ্ট।  
৫. অপ্রাপ্তবয়স্ক বা পাগলের ওপর জাকাত ফরজ নয়, কিন্তু ওশোর ফরজ। 
সরকারি খাজনা ও ওশোর : সরকারি খাজনা দিলেও ওশোর আদায় করতে হবে। কেননা ওশোর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা: কর্তৃক ধার্যকৃত অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। তা সরকার রহিত বা মা করতে পারে না। সরকার কর্তৃক ধার্যকৃত ভূমিকর বা আয়কর পরিশোধ করলে যেমন জাকাত আদায় হয় না, তেমনি ওশোরও আদায় হয় না। বরং এ দু’টি ফরজ অনাদায়ী থেকে যায়। কারণÑ
ষসরকার কর্তৃক ধার্যকৃত খাজনা ভূমির মালিকানার ভিত্তিতে হয়, ফসলের মালিকানার ভিত্তিতে হয় না। তাই ভূমির সম্পূর্ণ খাজনা শুধু তার মালিকের কাছ থেকেই মালিকানার ভিত্তিতে আদায় করা হয়। কিন্তু যে চাষি ভূমির মালিক নয়, তার কাছ থেকে কোনো খাজনা আদায় করা হয় না। তা ছাড়া জমিতে ফসল উৎপন্ন হোক বা না হোক সরকারি খাজনা দিতেই হয়।
ষওশোর পরিশোধ ফসলের মালিকানার ভিত্তিতে ফরজ করা হয়েছে। তাই কোনো মুসলিম ভূমির মালিক হওয়া সত্ত্বেও যদি কোনো কারণে তার ফসল না পায় তার ওপর ওশোর ফরজ হয় না। আবার কোনো মুসলিম চাষি কোনো ওশেরি ভূমির মালিক না হলেও সে যদি তার ফসল পায়, তবে সেই ফসলের মালিক হওয়ার কারণে ওশোর পরিশোধ করা তার ওপর ফরজ হয়।
ষখাজনা মুসলিম ও অমুসলিম উভয়ের ওপর আরোপ করা হয়, কিন্তু ওশোর শুধু মুসলিমদের ওপর ফরজ করা হয়েছে।
শেষ কথা : ইসলামি অর্থব্যবস্থায় ওশোর পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা। প্রচলিত খাজনা ব্যবস্থায় ভূমির মালিকানার জন্য সব নাগরিকই সমহারে খাজনা দিতে বাধ্য। এর বিপরীতে ওশোর (এক-দশমাংশ) ব্যবস্থা চালু হলে কৃষি আয় বণ্টনে বিরাজমান দুস্তর বৈষম্যের অবসান হবে এবং ধনী-দরিদ্রের মধ্যকার ব্যবধান কমে আসতে থাকবে।