মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর অসংখ্য মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এসব অনন্য মর্যাদা অন্য কোনো নবী বা রাসূলকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন দেননি। হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে হজরত ঈসা আ: পর্যন্ত যুগে যুগে যত নবী ও রাসূলকে আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মাত্র ২৫ জনের নাম আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে। নবী ও রাসূলের সংখ্যা মোট কত তার উল্লেখ আল কুরআনে না থাকলেও আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘এ ছাড়া এমন রাসূল পাঠিয়েছি যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শোনাইনি।’ (সূরা ইউনুস : ৪৭)।
কিন্তু হাদিস শরিফে এক লাখ ২৪ হাজার, ভিন্নমতে দুই লাখ ২৪ হাজার নবী ও রাসূলের কথা উল্লেখ রয়েছে।
এসব নবী ও রাসূলের ওপর বিশ্বাস স্থাপন এবং সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা যাবে না। এরশাদ হয়েছে, ‘রাসূল বিশ্বাস করেন ওই সব বিষয় সম্পর্কে, যা তাঁর পালনকর্তার পক্ষ থেকে তাঁর কাছে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মুমিনরাও। সবাই বিশ্বাস রাখে আল্লাহর প্রতি, তাঁর মালাইকাদের প্রতি। তাঁর গ্রন্থগুলোর প্রতি এবং পয়গম্বরদের প্রতি, তারা বলে, আমরা তার পয়গম্বরদের প্রতি পার্থক্য করি না।’ (সূরা বাকারা : ২৮৫)। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা মর্যাদার ক্ষেত্রে পয়গম্বরদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘এই রাসূলগণ আমি তাঁদের কাউকে কারো ওপরে মর্যাদা দিয়েছি। তাঁদের মধ্যে কিছু হলো তাঁরা যার সাথে আল্লাহ কথা বলেছেন। আর কারো মর্যাদা উচ্চতর করেছেন এবং আমি মরিয়ম-তনয় ঈসাকে প্রকৃষ্ট মোজেজা দান করেছি এবং তাকে শক্তি দান করেছি রুহুল কুদ্দুস অর্থাৎ জিব্রাইলের মাধ্যমে।’ (সূরা বাকারা : ২৫৩)।
আরো এরশাদ হয়েছে, ‘আমি তো কিছু গয়গম্বরকে কতক পয়গম্বরের ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৫৫)। আমাদের শেষ নবী মুহাম্মদ সা: কে আল্লাহ তায়ালা কিছু বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন, যা অন্য কোনো নবী-রাসূলকে দেননি। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য এই যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর মাধ্যমেই ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণতা দান করেছেন। হজরত আদম আ: থেকে রাসূলুল্লাহ সা:-এর আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত যত নবী ও রাসূল আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন তাঁদের কারো সময়েই ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে ঘোষণা দেননি। বিদায় হজের সময় রাসূলুল্লাহকে সম্বোধন করে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা দিলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। তোমাদের প্রতি আমার নিয়ামত পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সূরা মায়েদা : ৩)। মহানবী সা:-এর মাধ্যমে ইসলাম ধর্মের পরিপূর্ণতা দান তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ বহন করে।
মহানবী সা:-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি ইসলাম ধর্মের সর্বশেষ রাসূল। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘মুহাম্মদ কোনো ব্যক্তির পিতা নন এবং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী।’ (সূরা আহজাব : ৪০)।
মহানবী সা: যে সর্বশেষ রাসূল তা হাদিস শরিফেও উল্লেখ রয়েছে। বুখারি শরিফে হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আমার দৃষ্টান্ত এরূপ যেমন কোনো ব্যক্তি একটি ঘর তৈরি করেছে এবং সে ঘরটি সৌন্দর্যমণ্ডিত ও চাকচিক্যময় করেছে, কিন্তু নির্মাণের সময় কোনো একটি ইটের জায়গা শূন্য রাখে। এরপর লোকজন আনন্দ ও উৎসাহে তা দেখতে আসে এবং সন্তুষ্ট ও বিস্মিত হয়ে বলতে থাকে যে, এই একটি ইট কেন সংযোজন করা হয়নি (তাহলে ঘরের নির্মাণকাজ পূর্ণাঙ্গ হতো)। সুতরাং আমি সেই শূন্যস্থান পূর্ণকারী, আমি সেই নবুওয়াত খতমকারী।’ মুসলিম শরিফ, নাসায়ি ও তিরমিজি শরিফেও এ হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে।
শেষ নবী হিসেবে রাসূলুল্লাহ সা:-এর মর্যাদা অতুলনীয়। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি একমাত্র রাসূল, যাঁকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বনবীর মর্যাদা দান করেছেন। আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি, কিন্তু বেশির ভাগ মানুষ তা জানে না।’ (সূরা সাবা : ২৮)।
বুখারি শরিফের একটি হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা:-এর পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। তার মধ্যে তিনি যে বিশ্বনবী ছিলেন তারও বর্ণনা রয়েছে। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সব নবী প্রেরিত হতেন কেবল তাদের সম্প্রদায়ের জন্য, আর আমাকে প্রেরণ করা হয়েছে সমগ্র মানবজাতির জন্য।’
শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: যে বিশ্বনবী ছিলেন, এটা আজ সর্বজনবিদিত। আরবের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করলেও তাঁর প্রচারিত ধর্ম আজ সারা বিশ্বের মুসলিম জনগণের নিকট একমাত্র অনুসরণযোগ্য দ্বীন হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে মুসলিম নেই। সারা বিশ্বে ৫৬টি মুসলিম রাষ্ট্র রয়েছে। তা ছাড়া অমুসলিম রাষ্ট্রগুলোতেও রয়েছে ইসলাম ধর্মাবলম্বী অগণিত মুসলিম।
রাসূলুল্লাহ সা:-এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো কাফেরদের সাথে যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমত তার জন্য হালাল করা হয়েছিল। অথচ পূর্ববর্তী উম্মতদের জন্য তা হালাল ছিল না। গনিমতের ব্যবহার সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আপনার কাছে গনিমতের বিধান জিজ্ঞেস করে। বলে দিন, গনিমতের মাল হলো আল্লাহ ও রাসূলের।’ (সূরা আনফাল : ১)।
মুসনাদে আহমদ গ্রন্থের একটি সহি হাদিসের বরাত দিয়ে ইবনে কাসির বলেন, যে তাবুক অভিযানের প্রাক্কালে রাসূলুল্লাহ সা: তাহাজ্জুদের সালাত আদায় শেষে বললেন, ‘আজকের রাতে আমাকে এমন পাঁচটি বিষয় দান করা হয়েছে, যা আমার আগে আর কোনো নবী-রাসূলকে দেয়া হয়নি।
(১) আমার রিসালাত ও নবুওয়াতকে সমগ্র দুনিয়ার জাতিগুলোর জন্য ব্যাপক করা হয়েছে। আর আমার আগে যত নবী-রাসূলই এসেছেন তাঁদের দাওয়াত ও আবির্ভাব নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিল।
(২) কাফেরদের সাথে যুদ্ধে প্রাপ্ত গনিমত আমার জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে অথচ পূর্ববর্তী উম্মতগণের জন্য তা হালাল ছিল না, বরং এসব মালের ব্যবহার মহাপাপ বলে মনে করা হতো।
(৩) ‘আমার জন্য সমগ্র ভূমণ্ডলকে মসজিদ করে দেয়া হয়েছে এবং পবিত্র করার উপকরণ বানিয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে আমাদের সালাত যেকোনো জমি, যেকোনো জায়গায় শুদ্ধ হয়। কোনো বিশেষ মসজিদে সীমাবদ্ধ নয়। পক্ষান্তরে পূর্ববর্তী উম্মতদের ইবাদত শুধু তাদের উপাসনালয়েই হতো, অন্য কোথাও নয়। নিজেদের ঘরে কিংবা মাঠে ময়দানে তাদের সালাত বা ইবাদত হতো না। আরো বলা হয়েছে, ‘পানি ব্যবহারের যখন সামর্থ্য না থাকে, তা পানি না পাওয়ার জন্য হোক বা কোনো রোগ-শোকের কারণে হোক, তখন মাটি দ্বারা তায়াম্মুম নেয়াই যথেষ্ট হয়ে যায়। পূর্ববর্তী উম্মতগণের জন্য এ সুবিধা ছিল না।’
(৪) ‘আমাকে আমার শত্রু মোকাবেলায় এমন প্রভাব দান করা হয়েছে, যাতে তারা যদি আমার কাছ থেকে এক মাসের দূরত্বেও থাকে তবুও তাদের ওপর আমার প্রভাব ছেয়ে যাবে।
(৫) ‘আল্লাহ তায়ালা তার প্রত্যেক নবী-রাসূলকে একটি দোয়া কবুল হওয়ার এমন নিশ্চয়তা দান করেছেন, যার কোনো ব্যতিক্রম হতে পারে না। আর প্রত্যেক নবী-রাসূলই তাঁদের নিজ নিজ দোয়াকে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে দিয়েছেন এবং সে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। আমাকে তাই বলা হলো, আপনি কোনো একটা দোয়া করুন। আমি আমার দোয়া আখেরাতের জন্য সংরক্ষিত করিয়ে নিয়েছি। অর্থাৎ আমাকে শাফায়াতের অধিকার দেয়া হয়েছে।’
বুখারি শরিফে জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে বর্ণিত হাদিসে উপরিউক্ত পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। সর্বোপরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহানবী সা: কে ‘অবশ্যই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’ (সূরা কালাম : ৪) ঘোষণা দিয়ে এত বেশি মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন, যা অন্য কোনো নবী-রাসূলের বেলায় দেখা যায়নি। সমগ্র কুরআন শরিফে শেষ নবী সা:-এর নাম উল্লেখ করার পরিবর্তে তাঁর গুণাবলি ও পদবির মাধ্যমে তাঁকে সম্বোধন করা হয়েছে। বিশেষত আহ্বানের স্থলে ‘হে নবী’, ‘হে রাসূল’, ‘হে বস্ত্রাবৃত’, ‘হে চাদরাবৃত’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য পয়গম্বরকে সাধারণত নাম ধরে সম্বোধন করা হয়েছে। সমগ্র কুরআন শরিফে মাত্র চার স্থানে ‘মুহাম্মদ’ নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ‘মুহাম্মদ’ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সহচরগণ কাফেরদের প্রতি কঠোর, নিজেদের মধ্যে সহানুভূতিশীল।’ (সূরা আল ফাতাহ : ২৯)। শেষ নবী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘মুহাম্মদ কোনো ব্যক্তির পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল ও শেষ নবী।’ (সূরা আহজাব : ৪০)। এমন অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী রাসূলের উম্মত হওয়ার জন্য আমরা সৌভাগ্যবান, গৌরবান্বিত ও ধন্য। সে জন্য আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূলকে অনুসরণ করা প্রত্যেক মুসলিমের অপরিহার্য কর্তব্য।
উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল হাই (এ লেখাটি পাঠানোর পর লেখক ইন্তেকাল করেন)।
লেখক : সাবেক উপাধ্যক্ষ, সরকারি মহিলা কলেজ, ঝিনাইদহ