মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় মহানবী সা:

মহানবী সা: পৃথিবীতে এমন সময় আবির্ভূত হন, যে সময় শুধু আরববাসীই নয়, গোটা পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানবাধিকারের কোনো ধারণাই ছিল না। গোত্রপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি, সম্প্রদায়প্রীতি এত ব্যাপক ছিল যে, মানবিকতা, জাতীয় ঐক্য, সম্প্রীতি ও সদ্বভাবের কোনো নমুনাও তাদের কাছে ছিল কল্পনাতীত। মহানবী সা: এমন একটি সমাজে আবির্ভূত হয়ে মানবতার চরম অবমাননা দেখে ব্যথিত হলেন এবং উপলব্ধি করলেন যে, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করা।
তাই তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে গঠন করলেন ‘হিলফুল ফুজুল’ নামে মানবাধিকার কমিশন। ব্রিটিশ দার্শনিক জর্জ বার্নাড শ বলেছেন, ‘যদি গোটা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্ম, গোত্র, আদর্শ ও মানবতাসম্পন্ন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে এক নেতার অধীনে আনা হতো তবে একমাত্র মুহাম্মদ সা:-ই নেতারূপে তাদেরকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন।’
আধুনিক শিল্প বিপ্লবের ফলে সমৃদ্ধি লাভ করেছে অর্থনীতি ও সভ্যতা। পৃথিবীকে পরিণত করেছে গ্লোবাল ভিলেজে। এরও বহু আগে মহানবী সা: ঐক্যবদ্ধ করেছেন মানবজাতিকে, প্রতিষ্ঠা করেছেন শান্তি-শৃঙ্খলা এবং মানবাধিকার। তিনি শিক্ষা দিয়েছেন ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ অনেক বড়। তিনি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য করেছেন ‘মদিনা সনদ’, যা পৃৃথিবীর প্রথম লিখিত মানবাধিকার চুক্তি হিসেবে স্বীকৃত। যাকে অনুসরণ করে পৃথিবীতে গঠিত হয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও সংগঠন। মানবাধিকার লঙ্ঘন বর্তমান বিশ্বে একটি বার্নিং ইস্যু। আল্লাহ তায়ালাই কুরআনে বলেছেন : ‘হে নবী, আমি আপনাকে প্রেরণ করেছি বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ’ (আল-কুরআন)। মানবতা প্রতিষ্ঠায় একমাত্র রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শই পারে নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রদান করতে। এ জন্যই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন : ‘একমাত্র রাসূল সা:-এর জীবনেই রয়েছে উত্তম আদর্শ’ (আল-কুরআন)।
রাসূল সা: মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ব্যক্তিকে যেমন শ্রদ্ধা, সম্মান ও মর্যাদার কথা বলেছেন তেমনি মানুষের মধ্যে বংশ, গোত্র, ভাষা, বর্ণ, জাতিÑ এসবের পার্থক্যকে অস্বীকার করেছেন। জাতি, উপজাতি, বংশ, গোত্র, পরিবার প্রভৃতি বিভক্তি শুধু পারস্পরিক অধিকার, সমঝোতা সৃষ্টি ও পরিচিতির জন্য। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে : ‘হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে, পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করে দিয়েছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে। যাতে তোমরা পরস্পর একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পারো’ (আল-কুরআন : ৪৯ : ১৩)। রাসূল সা: মানবাধিকার এবং সার্বজনীন মৌলিক স্বাধীনতা প্রবর্তন করেছেন। পুরুষদের সাথে নারীদের সমান সামাজিক অধিকার প্রদান করে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্পূরক ভূমিকা নিশ্চিত করেছেন।
মানবাধিকার সম্পর্কে প্রথম বিবেচনার বিষয় হলো সুবিচার। মানবাধিকার অস্বীকার করা হলে বিচার হবে অর্থহীন। অষ্টাদশ শতাব্দীর মানবাধিকার চুক্তিপত্রের মতো রাসূল সা:-এর প্রণীত মানবাধিকার নীতি নিতান্তই রাজনৈতিক অধিকার নয়। রাসূল সা:-এর মানবাধিকার নীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে সামগ্রিকভাবে সম্প্রদায়ের অধিকার। এতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও আন্তর্জাতিক অধিকার ইত্যাদি সবই অন্তর্ভুক্ত। মানবাধিকার প্রসঙ্গটিতে রাসূল সা: তিনটি স্তরে বিভক্ত করেছেন। (ক) ব্যক্তি উদ্বুদ্ধকরণ ও নিশ্চিতকরণ; (খ) আইনি ব্যবস্থায় অধিকার সংরক্ষণ এবং (গ) ভবিষ্যতে আল্লাহ পাকের কাছে জবাবদিহিতা প্রদান।
অধিকারের প্রতি সতর্কতা প্রদান, উৎসাহ দান, সুবিচার ও সমানাধিকার নিশ্চতকরণে রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশনায় পরিপূর্ণ। রাসূলুল্লাহ সা: প্রণীত ভারসাম্যপূর্ণ সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার যে নির্দেশনা তার ফাউন্ডেশন বা ভিত্তি হলো ন্যায়বিচার। এই ন্যায়বিচারেই আসে মানুষে মানুষে সাম্য, শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি, সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণ, আইনি ও সরকারি জামানতের সুব্যবস্থা। রাসূলুল্লাহ সা: মানুষকে শুধু সত্যের পথ দেখাননি, সত্যের পথে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন। সুবিচার উপলব্ধি নয়, সুবিচার প্রতিষ্ঠা করতে বলেছেন।
রাসূলুল্লাহ সা: প্রণীত আইন দুর্বল ও সবলের জন্য যেমন এক, শাসক ও শষিতের জন্য, মুসলমান অমুসলমান, ইতর ভদ্র সবার জন্য তেমনই এক। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেন, ‘হে মানবগণ! তোমাদের প্রভু এক ও অদ্বিতীয়। তোমাদের আদি পিতা এক। তোমরা সবাই আদম হতে সৃষ্টি, আর আদম মাটির তৈরি। নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে সে অধিক মর্যাদাবান যে অধিক পরহেজগার। আরবের ওপর অনারবের, অনারবের ওপর আরবের, সাদার ওপর কালোর, কালোর ওপর সাদার কোনো পার্থক্য নেই। শুধু ধর্মানুরাগের কথা স্বতন্ত্র।’
রাসূলুল্লাহ সা: বিচারের ক্ষেত্রে যেমন সব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছেন তেমনই ব্যক্তিগত, সামাজিক ও মানবিক অধিকারও সুস্পষ্টভাবে প্রদান করেছেন। মানুষ তার কাক্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য স্বাধীনভাবে তার জ্ঞান ও যোগ্যতা ব্যবহার করতে পারে, এটা তার মৌলিক অধিকার। রাসূলুল্লাহ সা: একে তার ব্যক্তিগত অধিকার বলে স্বীকৃতি দেন। প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে তার গোপনীয়তা, সম্মান, খ্যাতি এবং নিজ অবস্থান রক্ষার। একটি রুচিসম্পন্ন, সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবনের জন্য গোপনীয়তা অপরিহার্য এবং মূল্যবানও বটে।
গৃহকর্ত্রীর অনুমতি ব্যতিরেকে গৃহাভ্যন্তরে প্রবেশ ইসলাম অনুমোদন করে না। শান্তি ও নিরাপত্তা অুণœ রাখা এবং অপবাদ ও অপমান থেকে প্রতিরোধে মানুষের গোপনীয়তা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক মানবিক অধিকার। মহানবী সা:-এর আদর্শ হলো, একজন মুসলমানের অনুচিত অন্য কারো অন্তরানুভূতিতে আঘাত হানা এবং অপবাদ দেয়া, বিদ্রƒপ করা, গিবত করা, বিকৃতনামে ডাকা, ছিদ্রান্বেষণ করা ও অন্যকে কষ্ট দেয়া। প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার সম্মানজনক ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের। রাসূলুল্লাহ সা:-এর নীতির অনুকরণে পরবর্তী সময়ে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ সার্বজনীন অধিকার ঘোষণার প্রস্তাবনায় উল্লেখ করে ‘জাতিগুলোর মধ্যে মৈত্রীর সম্পর্ক উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য।’
রাসূলুল্লাহ সা: বিপন্ন মানবতাকে রক্ষা করার জন্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিকার করার লক্ষ্যে গরিব-দুঃখী, দুর্বল-অসহায় এবং নির্যাতিত, নিপীড়িত, মজলুম জনগণকে জালিম ও সবল, বিত্তশালীদের হাত থেকে এবং অত্যাচারী শাসকের কবল থেকে রক্ষার জন্য শুধু প্রথম মানবাধিকার সংগঠন ‘হিলফুল ফুজুল’, বিশ্বের প্রথম লিখিত মানবাধিকার চুক্তি ‘মদিনা সনদ’-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। তিনি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন হুদায়বিয়ার সন্ধিতেও।
বদর যুদ্ধসহ অন্যান্য যুদ্ধে জয়লাভসহ মক্কা বিজয় পরবর্তী তিনি যে মানবতা দেখিয়েছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যেখানে রক্তের বন্যা প্রবাহিত হয়ার কথা সেখানে প্রবাহিত হলো শান্তির সমীরণ। মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়। সম্পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করল মানবাধিকার। ঐতিহাসিক গিবনের ভাষায় : In the long history of the world there is no instance of marginality and forgiveness which can approach those of Muhammad (Sm.) when all his enemies lay at his feet and he forgave them one and all.. হজরত মুহাম্মদ সা: তার পায়ের তলায় অবনত অবস্থায় সব শত্রুকে পেয়েও তাদের ক্ষমা করে ঔদার্য ও ক্ষমাশীলতার যে অনুপম আদর্শ প্রদর্শন করেন তার দ্বিতীয় কোনো নজির দুনিয়ার সুদীর্ঘ ইতিহাসে নেই।
মহানবী সা: মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এখানেই ক্ষান্ত হননি। মক্কা বিজয়ের দুই বছর পর বিদায় হজের ভাষণে যে মানবাধিকার বাস্তবায়নের অনুপম নীতি ঘোষণা করেছেন তা অবিস্মরণীয়, পৃথিবী যত দিন থাকবে এ নীতি তত দিন রোমন্থিত হবে। তিনি তাঁর ভাষণে মানবাধিকার সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়ে বললেন : ‘হে লোক সকল, তোমরা শোন, আইয়ামে জাহেলিয়াতের সব কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অনাচার আমার পায়ের নিচে পিষ্ট হলো।’ তিনি বলেন : ‘তোমাদের একের জানমাল, ইজ্জত ও রক্ত অপরের জন্য আজকের দিন ও মাসটির মতো এবং এই পবিত্র নগরীর মতো পবিত্র। কোনো অনারবের ওপর আরবের এবং আরবের ওপর অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কোনো কালোর ওপর সাদার এবং কোনো সাদার ওপর কালোর শ্রেষ্ঠত্ব নেই।
সবাই আদম থেকে সৃষ্টি আর আদম মাটি থেকে সৃষ্টি। শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি হচ্ছে তাকওয়া।’ তিনি এ সংক্রান্ত আরো বলেন : ‘নারীদের প্রতি পুরুষদের যেমন অধিকার রয়েছে তেমনি পুরুষদের প্রতিও নারীদের অধিকার রয়েছে। পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভালো ব্যবহার করবে। দাস-দাসী ও অধীনস্থদের প্রতি ভালো ব্যবহার করবে। নিজেরা যা খাবে ও পরবে তাদেরও তা খাওয়াবে এবং পরাবে। হাবশি গোলামও যদি আমির হয় তাকে মেনে নেবে। ধর্ম নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করবে না। বিচার মীমাংসা হবে ন্যায়ভিত্তিক।’
মহানবী সা:-এর বিদায় হজের ভাষণে মানবাধিকার-সংক্রান্ত বিধৃত মূলনীতিগুলো যে বিশ্বজনীন, মানবিক ও গণতান্ত্রিক তা প্রতিটি মানবহিতৈষী ও মানবতাবাদী ব্যক্তি স্বীকার করতে বাধ্য হবেন। এ ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে মহানবী সা: জানিয়ে দিলেন বিশ্বমানবতার কল্যাণের পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো এবং সমাধান করে দিলেন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সুন্দর পথ। জানিয়ে দিলেন মুসলিম সমাজ প্রতিষ্ঠিত সাম্য, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের ভিত্তির ওপর। মহানবী সা:-এর পুরো জীবনটাই ছিল মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত।