নবী আকরাম সা: একটি হাদিসে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের রুজি রোজগারের জন্য কাজ করে এবং সে কাজে লক্ষ্য থেকে আল্লাহর সন্তুটি অর্জন, তার দৃষ্টান্ত হজরত মুসা আ:-এর মায়ের মতো। তিনি নিজেরই সন্তানকে দুধ পান করান আবার তার বিনিময় লাভ করেন।’ যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, আর আমি পূর্বেই শিশুর (মুসা) জন্য স্তন্য দানকারিণীদের স্তন হারাম করে রেখেছিলাম। (এ অবস্থা দেখে) সে মেয়েটি (মুসার বোন) তাদের (ফেরাউনের লোকদের) বলল, ‘আমি তোমাদের এমন পরিবারের সন্ধান দেব যারা এর প্রতিপালনের দায়িত্ব নেবে এবং এর কল্যাণকামী হবে।’ এভাবে আমি মুসাকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে আনলাম, যাতে তার চোখ শীতল হয়, সে দুঃখ ভারাক্রান্ত না হয় এবং আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য বলে জেনে নেয়। কিন্তু বেশির ভাগ লোক এ কথা জানে না। (সূরা কাসাস-১২-১৩)
আল্লাহ মহান, আল্লাহর ব্যবস্থাপনা বড়ই সূক্ষ্ম। আল্লাহর ব্যবস্থাপনার সামনে মানুষ বড়ই অসহায়। যে ফেরাউনের কারণে শিশু মুসার জীবন সঙ্কটাপন্ন, আল্লাহর মহিমায় সেই ফেরাউনের তত্ত্বাবধানে নিজের মায়ের কোলে বাড়তি রিজিকের ব্যবস্থাসহ লালিত-পালিত হন। আল্লাহর এ কুশলী ব্যবস্থার ফলে আরো যে লাভটি হয়, তাহলো হজরত মুসাকে প্রকৃতপক্ষে ফেরাউনের শাহজাদা হতে হয়নি বরং নিজের মা-বাপ-ভাই-বোনের মধ্যে প্রতিপালিত হওয়ার কারণে নিজের আসল পরিচয় তিনি ভালোভাবেই অবহিত থাকতে পেরেছেন। নিজের পারিবারিক ঐতিহ্য ও নিজের জাতি থেকে তার সম্পর্কচ্যুতি ঘটতে পারেনি। তিনি ফেরাউন পরিবারের একজন সদস্য হওয়ার পরিবর্তে নিজের মানসিক আবেগ, অনুভূতি ও চিন্তাধারার দিক দিয়ে পুরোপুরিভাবে বনি ইসরাইলেরই একজন সদস্যে পরিণত হন।
বাড়তি রিজিকের ব্যবস্থাসহ নিজ সন্তানকে লালন-পালনের হজরত মুসার মায়ের এই কাহিনী আমাদের বাস্তব জীবনে অনুসরণীয় অনুকরীয় হতে পারে। আমরা যে যেই কর্মক্ষেত্রে কাজ করছি, সেখানে যদি পুরোপুরি আল্লাহর বিধান মেনে কাজ করি, তাতে মূল পারিশ্রমিক হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। আর নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের ভরণ-পোষণের জন্য যে বেতন-ভাতা পাওয়া যাবে, তা হবে আল্লাহর অতিরিক্ত অনুগ্রহ। যে সব প্রতিষ্ঠান সরাসরি আল্লাহর বিধানের সাথে সম্পর্কিত, সেসব প্রতিষ্ঠানের চাকরিটি হজরত মুসা আ:-এর মায়ের চাকরির সাথে হুবহু তুলনা করা যায়। কারণ মুসা আ:-এর মাতা তার সন্তানকে বিনা বেতনেই লালন-পালন করতে হতো, তার জন্য পারিশ্রমিকটুকু আল্লাহর অতিরিক্ত অনুগ্রহ। আমাদের মসজিদগুলোর ইমাম সাহেবদের ফরজিয়াত হিসেবে জামাতে নামাজ আদায় করতে হতো। সুতরাং ইমাম হিসেবে যে বেতনটুকু দেয়া হয় তা তাদের জন্য অতিরিক্ত আল্লাহর ফজল।
এমনিভাবে যে সামজের অর্থনীতি সুদনির্ভর, সে সমাজ থেকে সুদ উচ্ছেদ করে সুদমুক্ত সমাজ কায়েম করা প্রত্যেক ব্যক্তির ওপর ফরজ। কারণ সুদকে আল্লাহতায়ালা হারাম করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করে দিয়েছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। (সূরা বাকারা-২৭৫) কোনো সমাজব্যবস্থায় সুদ চালু রাখা মানে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সেই সমাজের অধিবাসীরা আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। সুদের এ সর্বোচ্চ গুনাহের কথা আল-কুরআনে পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্ববাসীগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর সুদের যা বকেয়া আছে তা পরিহার করো; যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না করো তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।’ (বাকারা-২৭৯)
এভাবে প্রতিদিন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধ করতে করতে অধিবাসীদের চরিত্র এতটাই পশুর রূপ ধারণ করে যে, সমাজের আনাচে-কানাচে জিনা-ব্যভিচার নিলর্জ্জভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অফিস, বাজারে, মহল্লায় মহল্লায়, ঘরে ঘরে জিনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঘৃণিত কাজটির জন্য যেন সমাজ সার্বিক অনুমোদন দিয়ে দেয়। ফলে এখন আর কারো কাছে তা ঘৃণার বিষয় নয়। হজরত আবু হোরায়রা রা: হতে বর্ণিত, রাসূল সা: বলেছেন, ‘সুদের সত্তর প্রকার গুনাহ রয়েছে। এর সর্বনি¤œ গুনাহ হলো নিজের মায়ের সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার সমতুল্য।’ (ইবনে মাজাহ)
সুদের অনেক ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এজন্য কুরআন ও হাদিসে অত্যন্ত কঠোরভাবে সুদ নিষিদ্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। একটি সুস্থ সমাজব্যবস্থার প্রয়োজনীয় মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো আন্তরিকতা, উদারতা, মহানুভবতা, দানশীলতা, সহানুভূতি ও কল্যাণকামিতা। কিন্তু সুদ সেই সমাজের লোকদের থেকে এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো ধ্বংস করে দেয় এবং সেখানে লোভ-লালসা, হিংসা, বিদ্বেষ নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, নির্মমতা ও কৃপণতার জন্ম দেয়।
সুদের এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে সমাজ ও তার অধিবাসীদের রক্ষার দায়িত্ব প্রতিটি মুমিন নর-নারীর ওপর বাধ্যতামূলক হিসেবে অর্পিত হয়। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মুসলিম অধ্যুষিত এই বাংলাদেশে ১৯৮৩ সালে আল্লাহর কিছু প্রিয় বান্দাহ সুদের এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে সমাজ ও জাতিকে মুক্তি দেয়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠা করেন ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে যারা ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করছেন, প্রত্যেকেরই মুসলিম হিসেবে দায়িত্ব হলো, সুদের করাল গ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করা এবং এর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
চাকরি করার জন্য তাদের যে বেতন-ভাতা দেয়া হয় তা অনেকটা মুসা আ:-এর মাতার পারিশ্রমিকের মতোই। যদিও তারা নিজের এবং নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেয়ার জন্য কাজ করেন কিন্তু যেহেতু তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ঈমানদারির সাথে কাজ করেন, যার সাথেই কাজ কারবার করেন তার হক যথাযথভাবে আদায় করেন এবং হালাল রিজিকের মাধ্যমে নিজের ও নিজের পরিবার পরিজনের ভরণ-পোষণকে আল্লাহর ইবাদত মনে করেন, তাই নিজের জীবিকা উপার্জনের জন্যও নিঃসন্দেহে তিনি আল্লাহর কাছে পুরস্কার লাভের অধিকারী হবেন। এক দিকে জীবিকাও উপার্জন করা হয় এবং অন্য দিকে আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব ও প্রতিদানও লাভ করা হয়।
ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মনে রাখতে হবে, এটি মূলত কোনো চাকরি নয় বরং পরম করুণাময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশেষ দায়িত্ব। আরো মনে করতে হবে যে, ষোল কোটি মানুষের দেশে কল্যাণমুখী ও সুদমুক্ত একটি সমাজ কায়েমের মহান কাজের জন্য মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে বিশেষভাবে নির্বাচিত করেছেন। সুতরাং এটিকে হেলাফেলা বা ট্রেডিশনাল চাকরিমাত্র মনে করার কোনো সুযোগ নেই। যদি কেউ শুধু শুধুই এটি চাকরি মনে করেন তাহলে এক দিকে যেমন এটি গুরুত্বর অপরাধ, অন্য দিকে আল্লাহর দেয়া দুনিয়া ও আখিরাতের মুক্তির একটি সুযোগকে হেলাফেলায় নিজের হাতে নষ্ট করারই শামিল। হজরত মুসা আ:-এর মাতা যদি ফেরাউনের চাকরি গ্রহণ না করতেন তাহলে এক দিকে যেমন নিজের প্রাণাধিক সন্তানটিকে কাছে পেতেন না, অন্য দিকে অতিরিক্ত রিজিক অর্জনের সুযোগটিও হাতছাড়া হতো। যারা ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত আছেন, তারাও যদি ঈমানদারি ও আন্তরিকতা পরিহার করে শুধুই শুধু চাকরি মনে করেন, তাহলে সব সুযোগ ও সুবিধা নিজের হাতে নষ্ট করা হলো।
এ চাকরিটিকে নিজের সন্তান লালন-পালনের মতোই মনে করতে হবে। প্রত্যেক কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে চোখের সামনে রাখতে হবে যে, ইসলামী ব্যাংকে চাকরির মাধ্যমে আমি আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে একটি অসম ও সর্বনাশা যুদ্ধে লিপ্ত দেশ জাতিকে বিরত রাখার চেষ্টা করছি এবং পথে-ঘাটে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া ব্যভিচার থেকে জাতিকে রক্ষা করার মহান কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে যারা সরকারি বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন তাদেরকেও সততা, নৈতিকতা বজায় রেখে আন্তরিকতার সাথে স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করতে হবে। মনে রাখতে হবে আপনার উপার্জন যদি হালাল না হয় তাহলে কোন ইবাদত বন্দেগী কাজে আসবে না। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের পূর্ব শর্ত ‘হালাল উপার্জন’।