সৃষ্টির মালিক আল্লাহ

সমগ্র সৃষ্টির যিনি মালিক, সৃষ্টিকে যিনি ঘিরে আছেন, সৃষ্টির প্রতিটি বিষয় যার নখদর্পণে, তিনি কোনো না কোনোভাবে সর্বত্র বিরাজমান। তিনি বলেছেন, ‘তিনি তোমাদের সাথে আছেন যেখানেই তোমরা থাকো না কেন’ (আল কুরআন)। তিনি সব কিছু দেখেন এবং শোনেন। তাঁর অসীম ক্ষমতা ও অপরিসীম দক্ষতা সম্পর্কে ধারণা করা মানুষের সাধ্যাতীত। তিনি অদ্বিতীয় এবং তাঁর কোনো তুলনা নেই। তিনি তাঁর অসীম জ্ঞান থেকে সামান্য মাত্র মানুষকে দান করেছেন। মানুষ তাই তার সসীম জ্ঞানে অসীম আল্লাহকে সামান্য মাত্রই উপলব্ধি করতে পারে।
সমুদ্রের বিশালতা, মেঘের গর্জন, ঝড়বৃষ্টির তাণ্ডব, মরুভূমির রুদ্রতাÑ সবই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার মহাব্যবস্থার প্রকাশ। কিছুই অনর্থক নয়। বিশাল বিশ্বকে তিনি শুধু সৃষ্টি করেননি, প্রত্যেক বস্তুকে ক্রিয়াশীল করে পরম লক্ষ্যে তাদের যথাযথ ভূমিকা চিহ্নিত করেছেন। কোথাও কোনো অসঙ্গতি নেই। ছন্দপতন কখনো ঘটে না। আকাশের অগণিত তারকারাজির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে বলে তিনি বলেছেন, ‘তোমরা কি কোনো ফাঁক দেখতে পাও?’ (আল কুরআন)। কোনো অসম্পূর্ণতা বা অসামঞ্জস্য তাঁর সৃষ্টির জন্য প্রযোজ্য নয়। তিনি কোনো কিছু সৃষ্টি করতে এরাদা করলে ‘হও’ বললে ‘হয়ে যায়’। কোনো খুঁত থাকার অবকাশ নেই।
পত্রপল্লবে সুশোভিত বৃক্ষরাজি, শাখে শাখে সবুজ কিশলয়, ফুলে-ফলে সজ্জিত মনোলোভা সৌন্দর্য এক অপরূপ দৃশ্যের অবতারণা করে। কোনো মানুষের পক্ষে এরূপ শৈল্পিক সৃষ্টি সম্ভবপর নয়। সর্বত্রই সুনিপুণ সৃষ্টির মাঝে এক বিস্ময়কর শিল্পীসত্তা মুখর হয়ে আছে। সৃষ্টির চেয়ে স্রষ্টা অনেক বেশি মহান।
আকাশের অসীম নীলে তারার মিছিল, গ্রহ-নক্ষত্রের পথপরিক্রমা এবং তাদের প্রত্যেকেরই সম্মিলিত সুশৃঙ্খল সহযাত্রা মানুষের জ্ঞান ও শক্তিকে বিস্ময়ে বিমুঢ় করে দেয়। কোথায় এদের এই সহযাত্রার নিয়ন্ত্রণ? কেমন করে বিশাল আকাশকে একই নির্দেশের অধীনে আনা সম্ভবপর?
সমগ্র পৃথিবীতে অসংখ্য পর্বতমালা কর্তব্যপরায়ণ রক্ষীর মতো স্থলভাগকে অটল রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত। সমুদ্রের বিশাল পানিরাশি ুদ্রতর পৃথিবীকে সাহায্য করে চলেছে, প্লাবিত করার ক্ষমতা রাখে না। সূর্য-চন্দ্রের বিপুল আলোভাণ্ডার অনাদিকাল থেকে সমভাবে আলো বিতরণ করে চলেছে, কখনো ব্যতিক্রম নেই। প্রশ্ন বারবার উঠেছেÑ এরা কি নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রক? জবাব মিলছে, ‘না’। তাহলে নিয়ন্ত্রণ কোথায়? সবারই নিশ্চুপ ইঙ্গিতÑ‘হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোনোখানে। ’
সৃষ্টিকে তাঁর কুদরত দ্বারা মহিমান্বিত করেছেন স্রষ্টা। স্রষ্টার সৌন্দর্য প্রতিবিম্বিত সৃষ্টি অনুপম রূপমাধুরী লাভ করেছে। সেই রূপের কোনো তুলনা নেই। একটি ঘাসের পাতায় যে সামগ্রিক সৌন্দর্য সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পপ্রয়াস তাঁর কাছে তুচ্ছ। সৃষ্টির মধ্যে মানুষকে তিনি আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মানুষকে দান করেছেন প্রতিনিধির সম্মান। ‘আমি বনি আদমকে সম্মানিত করেছি’ (আল কুরআন)। এই সম্মানিত মানুষ এতই ভাগ্যবান যে, সে তার সীমিত জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ তায়ালার ঘনিষ্ঠতা লাভ করতে সমর্থ। সে এমন পর্যায়ে উঠতে পারে যে নিজেকে আল্লাহ তায়ালার উপলব্ধির মাঝে হারিয়ে ফেলে বলে ওঠে, ‘আনাল হক’Ñ আমিই সত্য। আত্মোপলব্ধিতে বিমোহিত কবি নিজের মাঝে স্রষ্টার প্রকাশকে এভাবে প্রকাশ করেছেনÑ ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর, আমার মাঝে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।’ স্রষ্টা আছেন বলেই সৃষ্টি আছে। সৃষ্টি স্রষ্টার প্রকাশকে ধারণ করে ধন্য হয়েছে। সারা অবয়বে স্রষ্টার পরিচয় বহন করে এক অপূর্ব সুষমায় অভিষিক্ত হয়েছে। সৃষ্টিকে তাই আলাদা করে দেখার কোনো উপায় নেই। তাই বলে সৃষ্টি স্রষ্টা নয়।
আল্লাহ তায়ালা নিজেকে অদৃশ্য রেখে সৃষ্টির মাঝে নিজেকে পরিস্ফুট করে তুলেছেন। সৃষ্টি যে স্রষ্টা নয় এবং প্রতিটি বস্তু যে তাঁর ইচ্ছায় প্রকাশ, সে কথা আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেনÑ ‘তিনি মহাস্রষ্টা ও সর্বজ্ঞ।’
‘সূর্য, চন্দ্র ও অন্যান্য নক্ষত্ররাজিকে তিনি তার আজ্ঞাবহ রূপে সৃষ্টি করেছেন। মনে রাখিও, স্রষ্টা হওয়া কেবল তাঁরই জন্য নির্দিষ্ট এবং আদেশ কেবল তাঁরই। অতি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন আল্লাহ তায়ালা সমগ্র বিশ্বের প্রতিপালক।’