রাসূল সা:-কে পুরাপুরি অনুসরণের নির্দেশ স্বয়ং আল্লাহ জাল্লাশানুহুর। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তবে রাসূলের ওপর ন্যস্ত দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী এবং তোমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। যদি তোমরা তাঁর আনুগত্য করো, তবে সৎ পথ পাবে। আর রাসূলের কাজ তো কেবল স্পষ্ট রূপে বাণী পৌঁছে দেয়া’ (সূরা আন নূর : ৫৪)। আল্লাহ আরো বলেন, ‘আর তিনি রাসূল সা: নিজের থেকে মনগড়া খেয়াল-খুশিমতো কোনো কথা বলেন না। তাঁর কথা নিরেট ওহি, যা তাঁর প্রতি প্রেরিত হয়’ (সূরা আন নজম : ৩ ও ৪)। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল সা: যা বলেছেন, করেছেন ও করতে বলেছেন সবই পরোক্ষভাবে আল্লাহর নির্দেশ। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কুরআন ও হাদিস উভয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎস স্বয়ং আল্লাহ। কুরআন ও হাদিসের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণকারীদের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘোচাতে তথা ফরজ ও ওয়াজিব পালনের পাশাপাশি প্রদর্শিত সুন্নাত, রাসূল সা:-এর শিক্ষা, আদর্শ ও তরিকার অনুসরণের গুরুত্ব যে কত বেশি তা উপরিউক্ত বর্ণনাই একজন সচেতন ঈমানদার ও চিন্তাশীলের জন্য যথেষ্ট।
অনুসরণের নির্দেশবিষয়ক কুরআনের বর্ণনা : (১) ‘তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং অনুগত হও রাসূলের’ (সূরা আল ইমরান : ৩২)। (২) ‘ওহে যারা ঈমান এনেছ! তোমরা আনুগত্য করো আল্লাহর এবং আনুগত্য করো রাসূলের’ (সূরা আননিসা : ৫৯)। (৩) ‘আর তোমরা আল্লাহর আনুগত্য করো আর রাসূলের আনুগত্য করো এবং সতর্ক হও’ (সূরা আল মায়েদা : ৯২)।
অনুসরণকারীদের জন্য সুসংবাদ : রাসুল সা:-কে অনুসরণের নির্দেশ দেয়ার পাশাপাশি দয়াময়-মায়াময় আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে রাসূলুল্লাহর সা: অনুসরণ-অনুকরণে বাধ্য করার জন্য, অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করার জন্য পবিত্র কুরআনে অনুসরণের পুরস্কারস্বরূপ সুসংবাদও দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছেÑ (১) ‘আর যে কেউ আল্লাহর আনুগত্য করে এবং রাসূলের অনুসরণ করে, সে তো অবশ্যই মহাসাফল্য লাভ করবে’ (সূরা আহযাব : ৭১)। (২) ‘আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশে নহর প্রবাহিত হয়, তারা সেখানে চিরকাল থাকবে, এ হলো মহাসাফল্য’ (সূরা নিসা : ১৩)। (৩) ‘আপনি বলে দিন, যদি তোমরা প্রকৃতই আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণ করো, তবে আমার অনুসরণ করো, তাহলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালো বাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ মাফ করে দেবেন’ (সূরা আল ইমরান : ৩১)।
শৈথিল্য প্রদর্শনকারীদের ব্যাপারে হুঁশিয়ারি : ইসলামের পরিভাষায় সুন্নাতের অর্থ হচ্ছে, রাসূল সা:-এর জীবনাদর্শ, যা তার কথা, কাজ ও অনুমোদনের সমষ্টি। কুরআন ও হাদিসে সুন্নাত পালনের জন্য জোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি সুন্নাত পালনে উপেক্ষা করলে বা অবহেলা প্রদর্শন করলে এর ভয়াবহ পরিণামের কথাও আল্লাহ দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়েছেন। কারণ রাসূলকে অনুসরণ করা, অনুকরণ করা ঈমানের দাবি। কুরআনে বর্ণিত হুঁশিয়ারিমূলক কয়েকটি বর্ণনা : (১) ‘আর যে কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্য হবে এবং নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করবে, তিনি তাকে দোজখে দাখিল করবেন, সেখানে সে চিরকাল থাকবে’ (সূরা নিসা : ১৪)। (২) ‘কোনো মুমিন পুরুষ কিংবা মুমিন নারীর জন্য এ অবকাশ নেই যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যখন কোনো কাজের নির্দেশ দেন, তখন সে কাজে তাদের কোনো নিজস্ব সিদ্ধান্তের অধিকার থাকবে। কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করলে সে তো প্রকাশ্য পথভ্রষ্টতায় পতিত হয়’ (সূরা আহজাব : ৩৬)। (৩) ‘অতএব যারা তাঁর (রাসূলের) আদেশের বিরোধিতা করছে, তাদের ভয় করা উচিত যে, তাদের ওপর বিপর্যয় আপতিত হবে অথবা যন্ত্রণাদায়ক আজাব তাদেরকে গ্রাস করবে’ (সূরা নূর : ৬৩)।
ঈমানের দাবি : লাইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বলে ঈমানদার ঈমান আনয়নের যে স্বীকৃতি দেয়, এ স্বীকৃতি অনুযায়ী সুন্নাতকে গুরুত্ব না দেয়ার কোনো সুযোগ-অবকাশ কি মুসলমান নারী-পুরুষের জন্য রয়েছে? সূরা হাশরে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা সুন্নাতের অনুসরণের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্ণিত হয়েছে, ‘আর রাসূল তোমাদেরকে যা দেন (যা আদেশ করেন) তা তোমরা গ্রহণ এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাকো। আর ভয় করো আল্লাহকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা’ (সূরা হাশর : ৭)। রাসূল সা:-কে অনুসরণ-অনুকরণ না করে ঈমানদার দাবি করার, ঈমানের দাবিদার হওয়ার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।
মর্জিমাফিক অনুসরণ নয় : বিশ্বমানবতার জন্য, বিশেষ করে মুসলমানদের জন্য রাসূল সা: এক সর্বোত্তম আদর্শ ও রহমত স্বরূপ। তাঁর ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় জীবন যেমন আমাদের জন্য আদর্শ, তেমনি তাঁর পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক, সৈনিক তথা সংগ্রামী জীবনও আমাদের জন্য আদর্শ। বর্তমানে আমরা তাঁর সমগ্র আদর্শকে গ্রহণ না করে নিজেদের সুযোগ-সুবিধে, প্রয়োজন আর মর্জিমাফিক তাঁর আংশিক আদর্শকে মেনে চলছি। সহজ-সরল সুন্নাতের আংশিক অনুসরণ করে, কঠিন সুন্নাতগুলো বাদ দিয়ে রাসূল সা:-এর খাঁটি উম্মতের দাবিদার সেজে তাঁর শাফাতের আশায় বসে আছি আর কল্পনার রথে জান্নাতে পাড়ি জমাচ্ছি। অথচ আল্লাহর ঘোষণা হচ্ছে, ‘তাদের মধ্যে এমন অনেক আছে যারা মুর্খ ও নিরক্ষর। তারা মিথ্যা আকাক্সা ছাড়া আল্লাহর কিতাবের (কুরআন ও হাদিসের) কিছুই জানে না, তারা বাজে কল্পনার মধ্যে ডুবে আছে’ (সূরা বাকারা : ৭৮)। ধর্মের কিছু আদেশ-নিষেধ মেনে ও কিছু বর্জন-অমান্য করে আর রাসূল সা:-কে কিছু অনুসরণ করে এবং রাসূল সা:-এর কিছু সুন্নাতকে অমান্য করে অথবা কিছু সুন্নাতের ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করে কি আল্লাহর সন্তুষ্টি, দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তি পাওয়া যাবে? না, কখনো না।