ইসলামে মসজিদের গুরুত্ব

মসজিদ-মাদরাসা-মক্তব, ইমাম ও মুয়াজ্জিনÑ এগুলো মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনের সাথে একনিষ্ঠভাবে জড়িত। এসবের সাথে মুসলমানদের জড়িয়ে থাকার ইতিহাস নতুন কিছু নয়, অনেক পুরনো এবং ইসলামের প্রারম্ভিক যুগ থেকেই এসব ইসলামী সমাজকাঠামোর উল্লেখযোগ্য উপাদান। মুসলমানদের প্রথম মসজিদ হচ্ছে বায়তুল্লাহ, দ্বিতীয় মসজিদুল আকসা, তৃতীয় মসজিদে কোবা আর চতুর্থ মসজিদ হচ্ছে মসজিদে নববী। বায়তুল্লাহ শরিফ প্রথম মসজিদ হলেও হজরত মুহাম্মদ সা:-এর জীবনের প্রথম মসজিদ হচ্ছে কোবা। এই মসজিদটি মুহাম্মদ সা: খেজুরগাছের ডালপালা দিয়ে নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন, যা মক্কা ও মদিনার মাঝামাঝি কোবা নামক স্থানে অবস্থিত। মুহাম্মদ সা: সালাতের সময় নিজেই এই মসজিদে সালাতের জামায়াতে ইমামতি করেছিলেন। মদিনা থেকে এই মসজিদের দূরত্ব প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। এরপর তৈরি হয়েছিল মসজিদে নববী। মসজিদে নববীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বিদ্যালয়, গবেষণাকেন্দ্র, চিকিৎসাকেন্দ্র ইত্যাদি। মদিনা রাষ্ট্রের সেক্রেটারিয়েট বা সচিবালয়ও ছিল এই মসজিদে নব্বীর প্রাঙ্গণ। হজরত মুহাম্মদ সা: বেঁচে থাকা অবধি তিনি নিজেই নামাজের সময় এই মসজিদে ইমামতি করতেন।

‘মসজিদ’ আরবি ভাষার শব্দ। যার আবিধানিক অর্থ শ্রদ্ধাভরে মাথা অবনত করা। অর্থাৎ সিজদা করা। মসজিদের উৎপত্তি বা উৎকর্ষের ক্ষেত্রে সেই খোলাফায়ে রাশিদিনদের সময় থেকে আজ অবধি মসজিদ প্রতিষ্ঠার যাত্রা থেমে নেই। আরব উপদ্বীপে মসজিদের উৎপত্তি হলেও পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। ইসলামের বিজয়াভিযানের ফলে মসজিদ প্রতিষ্ঠা অনেক বেশি ত্বরান্বিত হয়েছে। মুসলমানেরা যে দেশই জয় করেছে, সে দেশেই তারা একসাথে এক জায়গায় সমবেত হওয়ার লক্ষ্যে মসজিদ নির্মাণ করেছে। যার ফলে বসরা কুফাসহ মধ্যপ্রাচ্যের সব দেশেই ইসলাম প্রসারের সাথে সাথেই মসজিদেরও বিপুল প্রসার ঘটেছে। ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দের দিকেই মিসর ইসলামী শাসনের অধীনে চলে আসে। সে সময় মসজিদগুলো হয়ে ওঠে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা-দীক্ষাসহ ইবাদত-বন্দেগির প্রাণকেন্দ্র। মসজিদে নব্বীর আদলে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যের মসজিদগুলো হয়ে ওঠে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার অনন্য প্রতিষ্ঠান। যার প্রভাব গোটা বিশ্বের সর্বত্র মধ্যযুগ পর্যন্ত ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল। এই দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে শাসনকর্তারা ও সমাজপতিদের জন্য মসজিদ প্রতিষ্ঠা করা একটি সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গণ্য হতো।
কথিত আছে সিরিয়ার এক শাসনকর্তা ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিন হাজার মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মুসলিম অধিপতিরা মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর হাদিস থেকে মসজিদ নির্মাণের অনুপ্রেরণা পেতেন। রাসূল সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একটি মসজিদ নির্মাণ করবে এর বিনিময়ে আল্লাহ তার জন্য বেহেশতে একটি বাড়ি নির্মাণ করবেন’ (বোখারি ও মুসলিম)। এই হাদিসে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুসলিমরা সমগ্র মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় সবার আগে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে। এই হাদিসের প্রতি মুসলিম সমাজ এখনো বিশেষভাবে অনুরক্ত। মধ্যযুগ পর্যন্ত মুসলিম শাসকেরা তাদের স্থাপত্য উৎকর্ষ ও শিল্পানুরাগ সাধারণত মসজিদ স্থাপত্যের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। ৬৮৭ খিষ্টাব্দে হজরত ওমর রা: জেরুসালেমে সর্বপ্রথম গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করেন। এরপর থেকে পারস্যের অনুকরণে সমগ্র ভারত উপমহাদেশে গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদের প্রচলন লক্ষ করা যায়। মোগল আমলে তৈরি হওয়া আগ্রার মোতি মসজিদ, দিল্লির জুমা মসজিদ, লাহোরের শাহি মসজিদ, পশ্চিমবঙ্গের বড় সোনা মসজিদ, ছোট সোনা মসজিদ, আদিনা মসজিদ এবং বাংলাদেশে বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পবিত্র কুরআন শরিফে মসজিদকে নিয়ে দিক নির্দেশনামূলক অনেক বক্তব্য রয়েছে। আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘এবং মসজিদগুলো আল্লাহরই জন্য, সেখানে আল্লাহর সহিত অন্য কাউকে ডেকো না’ (৭২:১৮)। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের চেহারাগুলোকে মসজিদের দিকে ফিরিয়ে নাও এবং একান্ত চিত্তে আল্লাহর ইবাদত করো’ (৭:২৯)। অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘হে বনী আদম! মসজিদে উপস্থিতির সময় তোমরা সুন্দর পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করবে’ (৭:৩১)। মসজিদ সম্পর্কে আল্লাহ আরো বলেন, ‘ওই ব্যক্তি হতে অধিক জালিম আর কে? যে মসজিদগুলোতে আল্লাহর জিকির করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করে এবং তার ধ্বংস সাধনে সচেষ্ট হয়। তাদের কখনোই নির্ভয়ে মসজিদে প্রবেশ করা উচিত নয়। দুনিয়াতে তারা অপদস্থ হবে এবং আখেরাতেও তাদের জন্য কঠোর শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে’ (২:১১৪)। আল্লাহ পাক এরশাদ করেছেন, ‘দুনিয়াতে সর্বোৎকৃষ্ট স্থান হলো মসজিদ আর নিকৃষ্টতম স্থান হলো বাজার ’ (মিশকাত শরিফ)।
মুসলমানদের জন্য মসজিদ হলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম স্থান। যেখানে একত্র হয়ে সঙ্ঘবদ্ধভাবে ইবাদত বন্দেগি করার জন্য মুসলমানদের আগমন ঘটে। গোটা মুসলিম সমাজকে একসূত্রে গ্রথিত করার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মিলনকেন্দ্র হচ্ছে মসজিদ। একসময় মুসলিম সমাজের সব সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুও ছিল মসজিদ। মুসলিম সমাজকে জ্ঞানপ্রদানের ভূমিকায় মসজিদের অবদান ছিল অনন্য। মুসলমানদের প্রাথমিক শিক্ষা এমনকি উচ্চশিক্ষারও হাতেখড়ি হতো মসজিদ থেকে। মসজিদ প্রাঙ্গণেই থাকত এসব বিদ্যালয়, যার নাম মক্তব। আধুনিক যুগে এই মক্তবের নামকরণ হয়েছে প্রাইমারি স্কুল। বিশেষজ্ঞ মুসলিম মনীষীরাই প্রাচীন সভ্যতায় প্রাইমারি স্কুল তথা মক্তবের রূপরেখা বা পরিকাঠামো তৈরি করেন। মসজিদভিত্তিক মক্তবগুলোই ছিল ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের প্রাণকেন্দ্র। ১০ শতকে সুন্নি আইনবিদ ইবনে হাজার আল হায়তামি মক্তব নিয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন তার প্রমাণও পাওয়া যায়। ১১ শতকে বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে সিনা তার একটি বইয়ে মক্তবে কর্মরত শিক্ষকদের দিকনির্দেশনার জন্য একটি অধ্যায় রচনা করেন। যার নাম দেন ‘শিশুদের প্রশিক্ষণ ও বেড়ে তোলায় শিক্ষকের ভূমিকা’। মসজিদভিত্তিক মক্তবের প্রভাবে প্রাচীন এথেন্সের তুলনায় মুসলিম সমাজে শিক্ষিতের হার ছিল সবচেয়ে বেশি।
মধ্যযুগ পর্যন্ত মসজিদকেন্দ্রিক বিদ্যানিকেতন থাকায় মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন নিয়োগে তেমন একটি ঝামেলা পোহাতে হতো না। বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীই ইমাম-মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করত একই পারিশ্রমিকে। ভারত উপমহাদেশেও সেই ধারাটি অব্যাহত ছিল। ইংরেজরা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার ওপর থেকে ধীরে ধীরে পৃষ্ঠপোষকতা তুলে দেয়া হয়। ফলে মসজিদভিত্তিক শিক্ষা তার গৌরব হারিয়ে ফেলে। যার কারণে ইবাদতের জন্য মসজিদ তৈরি হলেও সেসব মসজিদে ইমাম ও মোয়াজ্জিন নিয়োগে একপ্রকার জটিলতায় পড়তে হয়। মসজিদ পরিচালনা ও উন্নয়নের দায়িত্ব, ইমাম-মোয়াজ্জিন নিয়োগে দলাদলি। এসব কারণে এবং পাশ্চাত্ত্য শিক্ষার প্রসারে মুসলমানেরা ইসলাম থেকে যতটা সরে গেছে, মসজিদের গুরুত্ব মুসলিম সমাজ থেকে তার চেয়েও বেশি কমে গেছে।
মসজিদগুলোকে মুসলমানেরা আর আগের মতো সমাজ পরিচালনার কেন্দ্রবিন্দু মনে করে না। এ কারণে নামকাওয়াস্তে সর্বাধিক কম বেতনে অল্প শিক্ষিত একজন ইমাম আর কোনো রকমে আজান দিতে পারে, এমন একজন মোয়াজ্জিন দিয়ে পরিচালিত হয় মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান মসজিদ। এসব স্বল্প বেতনভুক ইমামের কাছ থেকে ইসলামী মূল্যবোধের জীবন সম্পর্কে কতটুকু ধারণা পাওয়া যেতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অথচ সমাজের সর্বোচ্চ জ্ঞানী ব্যক্তিকে মসজিদের ইমাম নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের মসজিদগুলোর ইমামদের যে পরিমাণে বেতন দেয়া হয় তাতেই অনুমান করা যায় আমরা ইসলামকে কোথায় স্থান দিয়েছি। যে বেতন ইমামদের দেয়া হয় তাতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা তো দূরের কথা ইমাম-মোয়াজ্জিন নিজেরাই চলতে পারেন না। দুর্ভাগ্য আমাদের এখানেই, যে জায়গাগুলোতে আমাদের বিনিয়োগ করা দরকার, সেখানে বিনিয়োগ না করে আমরা বিনিয়োগ করি অন্য কোনো খ্যাতে; যা দ্বারা সমাজের অকল্যাণই হয় সবচেয়ে বেশি। এ সবের একটি গঠনমূলক পরিবর্তন দরকার শিগগিরই।
সাম্প্রতিক মসজিদের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। মানুষ মসজিদগুলোকে জাঁকজমক করে তুলছে; সে তুলনায় মুসলিম তার আত্মিক পরিবর্তন করতে পারছে বলে মনে হয় না। মসজিদ যতই উন্নত হচ্ছে ইসলামী সংস্কৃতি মুসলমানদের জীবন থেকে সেভাবেই দূরে সরে যাচ্ছে।
মানুষ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর উন্নয়নকেই ধর্ম ভাবছে। সে কারণেই অবৈধ উপায়ে পয়সা রোজগার করে তার একটা অংশ মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করাকে অনেকেই আজকাল মুসলমানিত্ব ভাবছে। কিন্ত পরিষ্কার কোনো যুক্তি সহজেই হাতের কাছে না পাওয়ায় মানুষ এমনটি ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। অবৈধ ইনকামের পয়সায় মসজিদ নির্মাণে সহযোগিতা করার আগ্রহ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতারই ফল। অথচ মসজিদগুলো হয়ে উঠতে পারত অনৈতিক চেতনা প্রতিরোধের কার্যকর প্রতিষ্ঠান। মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজ কাঠামো তৈরি করতে চাইলে মসজিদগুলোকে আরো বেশি শক্তিশালী করা জরুরি। কেননা মসজিদই হয়ে উঠতে পারে সংস্কৃতি পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম।