হজের ইতিহাস

কাবাঘর নির্মাণ, এর তাওয়াফ, হজ পালন সৃষ্টির আদিকাল থেকে ধারাবাহিকভাবে চলে আসছে। আদি মানব ও মানবী হজরত আদম আ: ও হাওয়া আ: হজ পালন করেন। হজের কিছু কাজ তাঁদের অনুকরণে তাঁদের সন্তানগণ আজো পালন করে যাচ্ছে। কাবাঘর প্রথম নির্মাণ করেছিলেন কে? ফেরেশতাগণ না আদম আ:? এ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে বিজ্ঞজনের মাঝে। ভিন্নতা রয়েছে বর্ণনাগুলোতেও।
পৃথিবীর প্রথম নির্মিত ঘর : দুনিয়ার বুকে নির্মিত প্রথম ঘর কাবা শরিফ। ইরশাদ হচ্ছে ‘নিশ্চয়ই মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে গৃহ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা তো মক্কায়, তা বরকতময় ও বিশ্বজগতের দিশারী’ (আলে ইমরান:  ৯৬)। অনেক মুফাসসির মনে করেন, বসবাস ও ইবাদত উভয় দিক দিয়ে কাবা ছিল মানবসভ্যতার প্রথম ঘর। ভিন্ন মতে, এটি ছিল ইবাদতের নিমিত্ত নির্মিত প্রথম ঘর। আদম ও হাওয়া আ: দুনিয়ায় অবতরণের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দিগন্তে যাত্রা করেন। অবশেষে মক্কায় তাঁদের মাঝে মিলন ঘটে। আরাফা, মুজদালিফা, মিনা ও হাজরে আসওয়াদের ইতিহাস তাঁদের সাথেই সম্পর্কিত। বলা হয়, আরাফায় আদম ও হাওয়ার মাঝে দুনিয়ায় অবতরণের পর প্রথম পরিচয় ঘটে। মুজদালিফায় তাঁদের মাঝে আলাপ সংঘটিত হয়। মিনায় আদম আ:-এর আকাক্সা পূর্ণ হয়।
আরাফাহ : এটি একটি স্থানের নাম। এখানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ফরজ কাজ। এখানে অবস্থান করা না হলে হজ আদায় হয় না। ‘আরাফ’ ধাতু হতে আরাফাহ শব্দের উদ্ভব। অনেক তাত্ত্বিক মনে করেন, এখানে আদম ও হাওয়ার মাঝে পৃথিবীতে অবতরণের পর পরিচয় ঘটেছিল বলে আরাফাহ নামে তা প্রসিদ্ধি লাভ করে। (মোল্লা আলী কারী, মিরকাত, পাদটীকা সুনানু আবু দাউদ ১খণ্ড পৃ: ২৬৫)।
মুজদালিফা : এটি ইজদিলাফ শব্দ থেকে উদগত। এর অর্থ একত্রিত হওয়া, পাশাপাশি হওয়া। হজের একটি ঐতিহাসিক স্থানের নাম হলো মুজদালিফা। স্থানটি এ নামে পরিচিতি লাভের কারণ সম্পর্কে অনেক বিশেষজ্ঞের অভিমত হলো, এখানে এসে আদম ও হাওয়া একত্র হয়েছিলেন। (আল আসকালানি, ফাতাহুল বারি, বরাত পাদটীকা সুনানু আবু দাউদ, ১খণ্ড পৃ. ২৬৭)।
মিনা : এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান। হজের প্রধান কাজগুলো এখানে অবস্থান করে আদায় করা হয়। এর নামকরণের মাঝেও আদম আ:-এর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। জিব্রাইল আ: এখানে এসে আদম আ:-এর কাছ থেকে বিদায় নিতে চাইলেন। জিব্রাইল আ: তাঁকে বললেন, তুমি কিসের কামনা করো। আদম আ: বললেন, আমি জান্নাতের তামান্না করি। এ ‘তামান্না’ শব্দ থেকে মিনা পদের উৎপত্তি। (আইনি, উমদাতুলকারি, বরাত পাদটীকা হিদায়া ১খণ্ড পৃ. ২৪৪)।
জিব্রাইলের নির্দেশে আদম ও হাওয়ার কাবা নির্মাণ : ফেরেশতাগণ কর্তৃক প্রথমে কাবা নির্মিত হয়। অতঃপর জিব্রাইল আ: আদম ও হাওয়াকে তা নির্মাণের নির্দেশ দেন। তাঁরা কাবা নির্মাণের পর আল্লাহর নির্দেশে এর তাওয়াফ করেন। অতঃপর আদমপুত্র শিস আ: কাবা মেরামত করেন। বহুকাল পর হজরত নূহ আ: কাবায় হজ পালন করেন। হজরত আদম কাবা নির্মাণ করতে পাঁচটি পাহাড়ের পাথর ব্যবহার করেছিলেন। যেগুলো লুবনান, তুরে জাইতা, তুরে সায়না, আল জুদি ও হেরাÑ আবদুর রাজ্জাক, আল-মুসান্নাফ, মুহিব আত-তাবারি, শিফাউল গিরাম ১খণ্ড ৯২ বিশিষ্ট তাবেয়ি মুজাহিদ বলেন, হিন্দ অঞ্চল থেকে আদম আ: পদব্রজে চল্লিশ বার এলাকায় হজব্রত পালন করতে গিয়েছিলেন। তিনি এত দীর্ঘদেহী ছিলেন যে, তার একেকটি পদক্ষেপ তিন দিনের পথ ছিল। (সিরাত বিশ্বকোষ, ইফা, ১খণ্ড পৃ. ১০৪)।
হাজরে আসওয়াদ : হাজরে আসওয়াদ মানে কালো পাথর। এটি প্রথম দিকে ছিল হাজরে আবয়াদ বা সাদা পাথর। কালক্রমে পাপীতাপীর পাপ গ্রাস করে তা কালো রূপ ধারণ করে। এটি একটি জান্নাতি পাথর। হজরত আদম আ: জান্নাত থেকে নেমে আসার সময় সেটিকে সাথে নিয়ে আসেন। (সুনানু তিরমিজি ১খণ্ড ১৭৭, আজরাকি, তাওয়ারিখে মক্কা, পাদটীকা ঐ)।
জান্নাতি এ পাথরটির ইতিহাস আদম আ:-এর সাথে সম্পৃক্ত, এটি এখনো কাবাঘরের সাথে যুক্ত রয়েছে। তাওয়াফকালে তাতে চুমো খাওয়ার জন্য হাজীগণ প্রাণপণ চেষ্টা করেন। আদিকাল থেকে তা চলে আসছে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর নবুওয়াত লাভের আগে একবার কাবাঘর নির্মাণকালে পাথরটিকে যথাস্থানে পুনঃস্থাপন নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। প্রাক-ইসলামী যুগেও কাবাঘর ও হাজরে আওয়াদের প্রতি সম্মান জানানো হতো।
বিবদমান দলগুলোর মাঝে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দায়িত্ব পড়ে হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ওপর। তিনি সেটিকে একটি কাপড়ে রেখে সব গোত্রের গোত্রপতিকে সেই কাপড়ে ধরে যথাস্থানে রাখার পরামর্শ দিলেন। এভাবে সঙ্কটের সমাধান হয়। বোঝা গেল মুমিন, অমুমিন সবার কাছে কাবাঘর সমাদৃত ছিল। এ ঘটনার বহু বছর পর হজরত মুহাম্মদ সা: নবী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
বায়তুল্লাহর হজ করেছিলেন সব নবী : এ জগতে আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছিলেন। তাদের সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। সংখ্যার সাথে ঈমান-আমলের কোনো সম্পর্ক না থাকায় ইসলামে তা গৌণ। এক লাখ বা দুই লাখ নবীর সংখ্যা গণনা করা নিছক ধারণা মাত্র। এ নবীগণ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে প্রেরিত হয়েছিলেন। তবুও আল্লাহ তায়ালা দু-তিনজন ছাড়া সব নবী-রাসূলকে কাবা শরিফের হজ পালনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এ দুই বা তিনজন অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকায় হজ করতে পারেননি। এ ব্যাপারে ‘উরওয়াহ ইবন জুবায়র রা:-এর বর্ণনাটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, সব নবীই হজ পালন করেছিলেন। তবে হুদ ও সালেহ আ:-এর বিষয়টি ভিন্ন। নিজ নিজ উম্মতের কাজে ব্যস্ত থাকা অবস্থায় তাদের ইন্তেকাল হয়। নূহ আ: হজ করেন; কিন্তু তার সময়কালের প্লাবনে কাবাঘর আক্রান্ত হয়। ইব্রাহিম আ: পরবর্তীকালে এ ঘরের সন্ধান লাভ করলে তৎপরবর্তী সব নবী-রাসূল কাবার হজ করেছিলেন (বায়হাকি ৫খণ্ড  পৃ: ১৭৭, হাদিস নম্বর ১০১২২)।
আবু মুসা আল আশয়ারি রা: থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘রাওহা’ দিয়ে ৭০ জন নবী যাত্রা করেছিলেন, তাদের মধ্যে মুসা আ:ও ছিলেন। আবা পরিহিত, নগ্ন পা বিশিষ্ট এসব নবীর গন্তব্য ছিল আল্লাহর ঘর কাবা শরিফ। (তাবরানি বরাত আত-তারগিব ওয়াত তারহিব ২ খণ্ড ১৮০)। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, মুসা আ: লাল ষাঁড়ের ওপর সওয়ার হয়ে কুতওয়ানি জামা পরে হজ করেছিলেন। (তাবরানি বরাত আত তারগিব ওয়াত তারহিব গ্রাগুক্ত)। এ যদি হয় কাবাঘর ও হজের ইতিহাস তাহলে আবদুল্লাহ পুত্র মুহাম্মদ সা: হজের প্রবর্তক হন কিভাবে? হজের সম্পর্ক মানবসভ্যতার ইতিহাসের সাথে। হজরত মুহাম্মদ সা:-এর পূর্বেকার হাজার হাজার নবী-রাসূল হজ পালন করে আসছিলেন। তিনি ছিলেন আম্বিয়ায়ে কেরামের অনুসরণকারী মাত্র। পূর্ববর্তী নবী-রাসূলের হজের ইতিহাস আমাদের সামনে বিস্তারিত নেই। কেবল ইবরাহিম আ: ও তাঁর পুত্র ইসমাইল আ:-এর হজ সম্পর্কিত বিভিন্ন ঘটনা ইতিহাসে বিবৃত রয়েছে। তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন কর্মকাণ্ড হজের কাজ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এর কারণ হলো, ইবরাহিম আ: ছিলেন মুসলিম মিল্লাতের পিতা। আল কুরআনুল কারিমে তাঁদের কাবা নির্মাণ ও তৎসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের কথা স্পষ্টভাবে ইরশাদ হয়েছে। হজরত নূহ আ:-এর প্লাবনের পর কাবাঘর হজরত ইবরাহিম আ: কর্তৃক পুনরুদ্ধার হয়েছিল। ইবরাহিম তাঁর স্ত্রী রাজকুমারী হাজেরা ও তাদের পুত্র ইসমাইল আ:-এর স্মৃতি রয়েছে হজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। 
মাকামে ইবরাহিম : ইবরাহিম আ: যেই পাথরটিতে দাঁড়িয়ে কাবাঘর নির্মাণ করেছিলেন, তা এখনো অবিকৃত রয়েছে। তাঁর পদচিহ্ন বিশিষ্ট পাথরটি অতি যতেœ কাবার দরজার সামনে এখনো সংরক্ষিত। এখানে সালাত আদায় করার জন্য মহান আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। মক্কা বিজয়ের পর কাবাঘর থেকে রাসূলুল্লাহ সা: ইবরাহিম আ:-এর মূর্তি অপসারণ করেছিলেন। জমজম, সাফা-মারওয়াহ, মিনা ও জামারাহ ইত্যাদি ঐতিহাসিক চিহ্নাদি থাকা সত্ত্বেও ইবরাহিম আ:-এর মক্কায় আগমনকে অস্বীকার করা চরম বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব ছাড়া অন্য কিছু নয়, যা ইহুদি ও খ্রিষ্টানেরা করে থাকে। বিকৃত বাইবেলে ইবরাহিম আ:-এর মক্কায় আগমনকে অস্বীকার করা হয়েছে। এর চেয়ে হাস্যকর কোনো কথা পৃথিবীতে অন্য কিছু আছে বলে আমার জানা নেই।