মহানবী সা:-এর জীবনাদর্শ

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। আর এই পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থার ধারক ও বাহক বিশ্বনবী সা:। মহানবী সা: ইন্তেকালের পর হজরত আয়েশা সিদ্দিকা রা:-কে জিজ্ঞেস করেছিলেনÑ আম্মা, হজরতের জীবন থেকে আমাদের কিছু জ্ঞাত করুন। উত্তরে তিনি বলেছিলেনÑ তোমরা কুরআন শরিফ পড়োনি? কুরআনে যা বর্ণিত হয়েছে, হজরতের জীবনে তা-ই ঘটেছে।
মানবজীবনের বা জগতের শুরু থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত, জগতে এমন কোনো মানুষের জীবনেতিহাস আমরা অবগত নই যে, নির্দিষ্ট বিধিমতো তার সমগ্র জীবন নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়েছে।
মহানবী সা: ঘোষণা করলেন : আল্লাহ এক, অদ্বিতীয়, তিনি সবার। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ, অধঃ-ঊর্ধ্বে; আলো-আঁধারে গরিব-ধনী, রোগী-ভোগী, স্ত্রী-পুরুষ সবারই আল্লাহ তিনি। সব দেশের, সব কালের, সব জাতির তিনি প্রভুÑ তিনিই রব। সেই এককের মন্ত্র উচ্চারণ করে সব ভেদাভেদ ভুলে যুগ যুগ নির্মিত অচল প্রাচীর ধূলিসাৎ করে দিলেন। এক আহাদের বীজমন্ত্রে সব মানুষকে এক কাতারে দাঁড় করানোর অসাধ্য সাধনে ব্রতী হলেন। কালা-ধলা, সাদা-লাল, হলুদ-নীল সব বর্ণকে এক বর্ণে রঞ্জিত করে দিলেন। তাঁর সেই মোহনীয় একত্ববাদের সুরেই আজো দেশে দেশে মানুষকে এক বেদনার কমরেড ভাবার অনুভূতি প্রাণে প্রাণে অনুরণিত হওয়ার পরিচিহ্ন পরিস্ফুট দেখতে পাই। মহানবী সা: বলেছেনÑ ‘মানবসমাজে তিনি সর্বোত্তম ব্যক্তি, যিনি সব মানুষের পরিপূর্ণ মঙ্গল কামনা করেন।’ সর্বত্র তিনি তার মহান আদর্শ রেখে গেছেন।
মহানবী সা: নিজের জীবনে কোনো অবস্থাতেই আত্মীয়তার হককে বিন্দুমাত্র নষ্ট করেননি। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশীর হকের দিকেও তিনি নেকনজর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, নিজে খাওয়ার আগে ৪০টি ঘরে খোঁজ নিয়ে দেখো কে না খেয়ে আছে। রাসূলে খোদা নির্দেশ দিয়েছেন, কার সাথে কতটা আত্মীয়তা আছে তা যাতে ভুল না হয়, সে জন্য তোমাদের বংশের কুরসি নাম জেনে রাখা সঙ্গত।
আজ সারা বিশ্বে নবী সা:-এর আদর্শ ও আদেশ-নির্দেশ না মানায় মুসলিম উম্মাহর এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে।
পবিত্র কুরআনে উল্লেখ রয়েছে, ‘বেআদব কখনো আল্লাহর রহমত লাভ করে না।’ তাই মুসলমানদের আচার-ব্যবহার, আদব-কায়দা, শিষ্টাচারে মনোনিবেশ করতে হবে। আমাদের মহানবী সা:-এর ভাষায়Ñ জ্ঞানী লোকের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র। আর যার মধ্যে জ্ঞান ও বিবেক বিদ্যমান সেই হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত বা মানুষ। সুতরাং জ্ঞানের মাধ্যমে ইবাদত করতে হবে, অজ্ঞান লোকের ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না। অথচ আমরা সেই জ্ঞান থেকে দূরে সরে আছি। নবী সা: প্রথম উচ্চারণ করেছিলেন ‘ইকরা’Ñ পড়ো তোমার প্রভুর নামে। সেই পড়া থেকেও আমরা দূরে অবস্থান করছি। যার ফলে মুসলিম উম্মাহর আজ সর্বত্র দুরবস্থা বিরাজ করছে।
আমাদের কথার সাথে কাজের মিলের বিস্তর ফারাক রয়ে গেছে। আমরা আল্লাহকে মুখে ভয় পাই, অন্তরে ভয় পাই না। আমরা যদি আল্লাহকে অন্তরে ভয় পেতাম তবে কোনো অন্যায়, অপরাধ, অসত্য, মিথ্যা, বে-ইনসাফি আমাদের দ্বারা করা সম্ভব হতো না। আমরা নামাজ পড়ে মসজিদে ইসলাম রেখে আসি। সাথে রাখি না। কারণ ইসলাম সাথে থাকলে ওজনে কম দেয়া যাবে না, অন্যায় অপরাধ করা যাবে না, বেঈমানি করা যাবে না। অথচ পবিত্র কুরআনে পরিষ্কার বলা হয়েছে, তোমরা সম্পূর্ণভাবে ইসলামে দাখিল হও। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৫৬টি মুসলিম দেশে কোটি কোটি মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদ থেকে যদি এক দিনের দোয়া কবুল হতো, তবে মুসলিম উম্মাহর দুরবস্থা হতো না। কিন্তু দোয়া কবুল হচ্ছে না। কারণ আজ মিথ্যার সাগরে নিমজ্জিত মুসলমান।
নবী সা:-কে বলা হতো আল আমিন বা বিশ্বাসী। তিনি জীবনে কখনো মিথ্যা বলেননি। অথচ নবী করিম সা:-এর ওয়ারিশ ইমামগণ কি সবাই মিথ্যা পরিহার করতে পেরেছেন? পারেননি।
কুরআন-হাদিসে গড়া নবী সা:-এর আদর্শ আমাদের মানতে হবে। মুসলিম উম্মাহর দুরবস্থা দূর করতে মহানবী সা:-এর আদর্শ মানা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ আমার জানা নেই। কেননা ১৪ শত বছর আগে সমগ্র জগতের অসহায় উৎপীড়িত মানুষের উত্থানের মহাবাণী নিয়ে মহানবী আবির্ভূত হয়েছিলেন। নিপীড়িত ব্যথিত বুভুু ও লাঞ্ছিতের অপমান দূর করে মানবধর্মের প্রতিষ্ঠা করে তিনি জগতে এক নবযুগের প্রবর্তন করেছিলেন। ইসলামের মহাপ্রবর্তক সত্য প্রচার করতে গিয়ে কোনো কিছুতেই ভীত হননি
জাগতিক কোনো কিছুর ভয়ে সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। ক্ষমতা, তরবারি, রাজমুকুট কিছুকেই পরোয়া করেননি বা কিছুতেই প্রলুব্ধ হননি। হজরত সা: প্রেম ও সেবা দ্বারা ইহুদি, খ্রিষ্টান, অগ্নি-উপাসক, জড়বাদী সবাইকে মানবধর্মের মহাসত্যে দীক্ষা দান করেছিলেন। অজ্ঞতা ও গোঁড়ামির কুয়াশা কাটিয়ে বংশাভিমান, ধনসম্পদের গর্ব, শারীরিক শক্তি, গোষ্ঠী প্রাধান্য, কুলমর্যাদার গণ্ডি ভেঙে মানুষ যে মানুষের ভাইÑ এই মহাবাণীর পরম সত্য সবাইকে হৃদয়ঙ্গম করিয়েছিলেন।
মহানবী সা: নিজে ব্যবসায় করেছেন। কায়িক শ্রমের কাজ করেছেন, দুঃখী-দরিদ্র অসহায়ের খাবার বহন করেছেন। তিনি তো মশারির তলায় পর্দার আড়ালে সর্বদা বসে থাকেননি। হজরত সা: তো কেবল বেহেশতের কথাই বলেননি; ব্যবসায়ের কথা, বাণিজ্যের কথা, শিক্ষার কথা, ভাইয়ে ভাইয়ে মিলেমিশে থাকার কথা বলেছেন। তিনি তো দোয়াল্লিন-জোয়াল্লিন নিয়ে, জেকের জলি ও জিকির খফি নিয়ে বাহাসের নামে মুসলমানে মুসলমানে দলাদলি বা ঝগড়াফাসাদ করেননি। দুনিয়ায় অহেতুক মামলা-মোকদ্দমা কিংবা আত্মকলহ সৃষ্টির কাজকে তিনি সমর্থন করেননি।
অপর জাতির প্রতি অন্যায়-অত্যাচার কিংবা ঘৃণাবিদ্বেষ পোষণ করেননি। যেকোনো দেশের মানুষ যেকোনো ধর্মের বা জাতির মানুষ তাঁর কাছে ন্যায়বিচার পেয়েছেন। তিনি তো ভিক্ষাবৃত্তি করেননি, সাওয়াল করেননি, কারো কাছে কোনো কিছু সাহায্যপ্রার্থীও হননি। ভিুক-সাওয়ালকারী কি দেশ, জাতি ও কওমের পথপ্রদর্শক হতে পারে? দেশের জন্য, জাতির জন্য, সত্যের জন্য, মানুষের জীবনের মঙ্গলের জন্য হজরত সা: যা করেছেন সেটাই হবে আমাদের জীবনের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য।
আজ মুসলিম উম্মাহ যদি তাদের দুরবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চায়, তবে দশটি জিনিস পরিহার করে হৃদয়কে আয়নার মতো উজ্জ্বল করতে হবে। সেগুলো হচ্ছেÑ লোভ, কামনা, কৃপণতা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার, হিংসা, প্রবঞ্চনা, পরশ্রীকারতা, ক্রোধ ও অহঙ্কার। এবার আল্লাহর নৈকট্য ও ইসলামের শান্তির জন্য হৃদয়ে ১০ জিনিস সাজাতে বা ঢুকাতে হবে। সেগুলো হলোÑ ধৈর্য, সততা, কৃতজ্ঞতা, সন্তুষ্টি, দৃঢ়বিশ্বাস, পবিত্রত, দানশীলতা, সাহসিকতা, আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতা ও পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ।
জগতে বেঁচে থাকতে টাকা চাই, জমি টাই, দৌলত চাই, কর্ম চাই, স্বাস্থ্য চাই, সামর্থ্য চাই; কিন্তু আত্মাকে জিন্দা রাখতে মহাজীবনের সঙ্গ চাই, সান্নিধ্য চাই, নৈকট্য চাই। যিনি যা-ই বলুন না কেন, মানুষের মতো মানুষের স্নেহের ছায়া, প্রেমের স্পর্শ, দরদের ছোঁয়া ছাড়া সংসারে তাপদগ্ধ মানুষের শান্তির আশ্রয় আর কোথায়ও নেই। দেশ ও জাতিকে ভালো করতে চাইলে নিজেকে আগে ভালো হতে হবে। আর নিজেকে ভালো করতে হলে ভালো মানুষের সন্ধান করতে হবে।
মোটকথা জীবন ও জীবিকা নির্বাহের স্তরে স্তরে মহানবীর মহাবাণীর সুস্পষ্ট নির্দেশ অন্তরে অন্তরে প্রতিফলিত হলে মুসলিম উম্মাহর সব সমস্যা, বিরোধ ও সংঘর্ষের মীমাংসা সম্ভব। এই মহাজীবনের অগ্নিকণা আহরণ করে চলার পথের অন্ধকার দূর করা ছাড়া কোনো উপায় উদ্ভাবিত হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই।