ধনসম্পদ উপার্জন মানুষের সহজাত প্রকৃতি। ইসলাম এটাকে মন্দ বলেনি, বরং এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার জন্য জোরালো তাগিদ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি ন্যায়-অন্যায় ও হালাল- হারামের সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়ে অন্যায় ও অবৈধ পথে সম্পদ উপার্জন থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোর নির্দেশ প্রদান করেছে।
অবৈধ ও হারাম সম্পদ উপার্জন ও ভোগ করা সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অবৈধভাবে ভোগ কোরো না’ (সূরা আন-নিসা:২৯)। হজরত ইবনে আব্বাস বলেনÑ ‘এর অর্থ হচ্ছে, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন শপথ দ্বারা অন্যের সম্পত্তির ওপর নিজের দখল প্রতিষ্ঠা করা।’ অবৈধভাবে হারাম পন্থায় উপার্জন দুই রকম হতে পারেÑ প্রথমত, সম্পূর্ণরূপে শক্তি প্রয়োগে ও অত্যাচারের মাধ্যমে; যেমন আত্মসাৎ, অপহরণ, জবরদখল, গচ্ছিত সম্পদ বিশ্বাসঘাতকতার সাথে ভোগদখল, চুরি-ডাকাতি ইত্যাদি।
দ্বিতীয়ত, খেলাধুলা, চালাকি, প্রতারণা ইত্যাদি। লটারি ও জুয়ার মাধ্যমে অর্থ জেতাও এর আওতাভুক্ত। সহিহ বুখারিতে উল্লেখ আছে, রাসূল সা: বলেন, ‘যারা আল্লাহর সম্পদে অন্যায়ভাবে হস্তপে করে কেয়ামতে তাদের জন্য জাহান্নাম নির্দিষ্ট রয়েছে।’ সহিহ মুসলিমে আছে, রাসূল সা: বলেছেন, ‘এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফরে থাকা অবস্থায় এলোমেলো চুল ও ধূলিধূসরিত দেহ নিয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে ‘হে প্রভু! হে প্রভু!’ বলে মুনাজাত করে, অথচ সে যা খায় তা হারাম, যা পান করে তা হারাম, যা পরিধান করে তা হারাম এবং হারামের দ্বারাই সে পুষ্টি অর্জন করে। তার মুনাজাত কিভাবে কবুল হবে?’ হজরত আনাস বলেন, ‘আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কাছে আমার জন্য দোয়া করেন তিনি যেন আমার দোয়া কবুল করেন।’ উত্তরে রাসূল সা: বললেন, ‘হে আনাস, তোমার উপার্জনকে হালাল রাখো, তোমার দোয়া কবুল হবে। মনে রেখো, কেউ যদি হারাম খাদ্যের একগ্রাসও মুখে নেয়, তাহলে চল্লিশ দিন পর্যন্ত দোয়া কবুল হবে না।’ বায়হাকিতে বর্ণিত আছে, রাসূল সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যেমন তোমাদের মধ্যে জীবিকা বণ্টন করেছেন, তেমনিভাবে তোমাদের স্বভাব-চরিত্রও বণ্টন করেছেন। দুনিয়ার সম্পদ তিনি যাকে ভালোবাসেন তাকে দেন, যাকে ভালো বাসেন না তাকেও দেন। কিন্তু আখেরাতের সম্পদ কেবল তাকেই দেন, যাকে তিনি ভালোবাসেন।
আল্লাহ যাকে দ্বীন দান করেছেন, বুঝতে হবে যে তিনি তাকে ভালোবাসেন। কোনো বান্দা হারাম উপার্জন করে তা নিজের প্রয়োজনে ব্যয় করলে তা থেকে বরকত বা কল্যাণ লাভ করবে না। অন্যকে দান করলে সে দান কবুল হবে না, আর যেটুকু দুনিয়ায় রেখে যায় সেটুকু জাহান্নামের সন্বল হবে। আল্লাহ মন্দকে দিয়ে মন্দ প্রতিহত করেন না, ভালোকে দিয়ে মন্দ প্রতিহত করেন’ (মুসনাদে আহমদ)। হজরত ইবনে ওমর রা: বর্ণনা করেন রাসূল সা: বলেছেন, ‘পৃথিবী মিষ্ট ও শ্যামল। এখানে যে ব্যক্তি হালাল সম্পদ উপার্জন করবে এবং ন্যায়সঙ্গত পথে তা ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে উত্তম প্রতিদান দেবেন, তাকে জান্নাত দান করবেন। আর যে ব্যক্তি হারাম সম্পদ উপার্জন করবে এবং তা অন্যায় পথে ব্যয় করবে, আল্লাহ তাকে অপমানজনক স্থানে নির্বাসিত করবেন। আর হারাম সম্পদ
হস্তগতকারীরা কেয়ামতের দিন আগুনে জ্বলবে। রাসূল সা: আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের সম্পদ কোথা থেকে উপার্জন করবে পরোয়া করে না, আল্লাহ তায়ালা তাকে কোন দরজা দিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন তার পরোয়া করবেন না।’ হজরত আবু হুরাইরা রা: বলেন, ‘কোনো মুসলমানের হারাম জিনিস খাওয়ার চেয়ে মাটি খাওয়া ভালো’ (মুসনাদে আহমদ)। রাসূল সা: আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি হারাম অর্থ ব্যয় করে হজে গিয়ে বলে, ‘লাব্বাইক’ (হে প্রভু আমি হাজির), তাকে একজন ফেরেশতা বলেন, ‘তোমার লাব্বাইক গ্রহণযোগ্য নয়। তোমার হজ তোমার মুখের ওপরই ছুড়ে দেয়া হলো’ (তাবরানি)। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছেÑ রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দশ দিরহাম দিয়ে কোনো কাপড় কিনল এবং এর মধ্যে এক দিরহাম অসৎ উপায়ে অর্জিত, সে যত দিন ওই কাপড় পরিধান করে থাকবে তত দিন তার নামাজ কবুল হবে না।
ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর রা: যখন খানা খাইতেন তখন খাওয়ার আগে তার খাদেমকে জিজ্ঞাসা করতেন। এক দিন খলিফা প্রচণ্ড ুধার্ত থাকায় খানা সর্ম্পকে জিজ্ঞাসা করতে পারেননি। ওই দিন খানার সাথে ছিল দুধ আর মধু। খানা শেষ করার পর তার খাদেমকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দুধ-মধু কোথা থেকে আনা হয়েছে?’ খাদেম বললেন, ‘এক ব্যক্তি ছিল মুশরিক। সে বিভিন্ন কুফুরি কালাম ব্যবহার করত, তাতে মানুষের উদ্দেশ্য সাধিত হতো। ফলে অনেকে সন্তোষে তাকে অর্থ ও দুধ-মধু দিত। সে মধু ও দুধ আপনার জন্য পাঠায়। তা থেকে আপনাকে খেতে দেয়া হয়েছে।’ খাদেম আরো বলল, ‘সে এখন মুসলমান হয়েছে।’ এ কথা শুনে খলিফা রেগে গেলেন। খাদেমকে বললেন, ‘তুমি এ দুধ-মধু কেন আমাকে খেতে দিলে?’ এরপর খলিফা গলায় আঙুল দিয়ে সব খাদ্য বমি করে দিলেন। এরপর গলায় আঙুুল দিয়ে উপর্যুপরি করাঘাত করতে লাগলেন। ফলে গলা থেকে রক্ত বের হতে লাগল। ইত্যবসরে হজরত উমার রা: উপস্থিত হলেন। তিনি বললেন, ‘হে আবু বকর, আপনি যা খেয়েছেন তা সব বের হয়ে গেছে, এখন রক্ত বের হচ্ছে। তখন আবু বকর রা: বললেন, হে উমার তুমি রাসূল সা:-কে এ কথা বলতে শোনো নাই যে, হারাম খাওয়ার পর যার শরীরে এক ফোঁটা রক্ত তৈরি হবে, ওই শরীর জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে।
আল্লাহ রব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, ‘তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস কোরো না এবং মানুষের ধনসম্পদের কিয়দংশও জেনেশুনে অন্যায়ভাবে গ্রাস করার উদ্দেশ্যে তা বিচারকদের কাছে পেশ কোরো না’ (সূরা বাকারা : ১৮৮)। উপরিউক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরকারগণ বলেন, ‘এতে ইঙ্গিত করা হয়েছেÑ তোমরা যখন অন্যের সম্পদ অবৈধভাবে আত্মসাৎ করো, তখন এ কথা চিন্তা করবে যে, অন্যেরও নিজ সম্পদের প্রতি ভালোবাসা রয়েছে, যেমন তোমাদের নিজেদের ধনসম্পদের ওপর ভালোবাসা রয়েছে। তারা যদি তোমার সম্পদ অবৈধভাবে হস্তপে করে, তাহলে তোমার যেমন কষ্ট অনুভব হবে, তেমনিভাবে তাদের েেত্রও তুমি একইভাবে কষ্ট অনুভব করো, যেন এটাও তোমার সম্পদ।’
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমার রা: বলেন, ‘একবার রাসূল সা: তাঁর ভাষণে বলেন, ‘হে মহাজিরিনের দল! কয়েকটি অভ্যাসের ব্যাপারে আল্লাহর কাছে পানাহ চাই। সেগুলো তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি না হয়ে যায় ! তার একটি হলো, যখন কোনো জাতির মধ্যে মাপে কারচুপি করার প্রবণতা সৃষ্টি হয়, তখন তাদের মধ্যে দুর্ভি, রোগ-শোক এবং জনগণের ওপর শাসক শ্রেণীর অত্যাচার-নিপীড়ন চাপিয়ে দেয়া হয়’ (ইবনে মাজা)।
আমাদের এই বিচিত্র সমাজে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জন করে অনেককে দান-সদকা করতে দেখা যায়। অথচ এ ব্যাপারে আল্লাহর নবীর সুস্পষ্ট ঘোষণা রয়েছে, হজরত আবদুুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা: থেকে বর্ণিত, রাসূল সা: এরশাদ করেছেন, ‘আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যার হাতে আমার প্রাণÑ কোনো মানুষ যখন নিজের হারাম সম্পদ থেকে ব্যয় (দান-সদকা) করে, আল্লাহ তার দান কবুল করেন না’ (মুসলিম)। অবৈধ ধনসম্পদ অর্জনকারীদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাত কণ্টকাকীর্ণ। অন্যায় কাজ পরিত্যাগের জন্য মানুষের সদিচ্ছা যথেষ্ট। আমরা মুসলমান হিসেবে এ কথা চিন্তা করতে পারি না যে, এই জীবন আমার শেষ জীবন। হাশরের ময়দানে খোদ শাহানশাহ আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে আমার অর্জিত প্রতিটি পয়সার পাই পাই হিসাব আমাকে দিতে হবে। তবুও কি আমরা এসব গর্হিত কাজ থেকে নিবৃত্ত হবো না?