সৌভাগ্যবান মা-বাবা

প্রাগৈতিহাসিক যুগে নারীসমাজ যখন অত্যাচারের জাঁতাকলে হচ্ছিল নিষ্পেষিত, তাদের করুণ আর্তনাদে যখন আকাশ-বাতাস হচ্ছিল প্রকম্পিত, নারী নির্যাতন ও জীবন্ত কন্যাসন্তান কবর দেয়ার মতো বর্বরতায় যখন সমগ্র বিশ্ব ছিল তমশাচ্ছন্নÑ এমনই এক সন্ধিণে মহানবী সা: নারী জাতির উন্নয়নে এনেছেন এক বৈপ্লবিক সংস্কার। ঘৃণিত, অবহেলিত এ জাতির ভাগ্যোন্নয়নে গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন পদপে। একই উৎস থেকে সৃষ্ট ছেলে ও মেয়ের মাঝে একে অপরের ওপর কোনো প্রাধান্য রাখেননি তিনি। মৌলিকতার দিক থেকেও উভয়ের মাঝে রাখেননি কোনো শ্রেষ্ঠত্ব; বরং একে অপরের পরিপূরক হিসেবে সমাজে করেছেন প্রতিষ্ঠিত।
নবুওয়াত-পূর্ব যুগে কন্যাসন্তান : নবুওয়াত-পূর্ব যুগে বিভিন্ন ধর্ম ও সভ্যতায় নারীকে জীবজন্তু এবং ব্যবহারিক সামগ্রীর মতো মনে করা হতো। দুর্ভাগ্যের প্রতীক, অপকর্মের উৎস, শয়তানের দোসর, নরকের দ্বার, যৌন চাহিদাচরিতার্থ করার বাহন হিসেবেই পরিচিত ছিল নারী। কন্যাসন্তান ছিল লাঞ্ছনা, লজ্জা ও পাপের মূর্ত প্রতীক। তাদের জন্মকে মনে করা হতো অলণে। তৎকালীন সমাজে মেয়ে হিসেবে একজন নারী পেত না পিতৃস্নেহ বরং জীবন্ত মেয়েকে তারা মাটিতে পুঁতে রাখতে সামান্য দ্বিধা করত না। কারো মেয়ে ভূমিষ্ঠ হলে মা-বাবা লজ্জায় শির অবনত করে রাখত। 
মানবসভ্যতার ইতিহাসে নারীর মর্যাদার জন্য যিনি প্রথম সোচ্চার হয়ে ওঠেন, নারীকে সংসার, সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে প্রথম স্বীকৃতি দান করেন, সত্যিকার অর্থে নারী জাগরণ ও নারী মুক্তির যিনি প্রবক্তা, যিনি মেয়ে হিসেবে একজন নারীকে প্রদান করেছেন সঠিক মর্যাদা, তিনিই হচ্ছেন মহানবী সা:। 
কন্যাসন্তান হত্যা রোধ : কন্যাসন্তান হত্যার বিরুদ্ধে মহানবী সা: সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে নবুওয়াত পূর্ব যুগের এ প্রথাকে চিরতরে বন্ধ করেন। তিনি কুরআনের আয়াতটি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘নিশ্চয় ওই সব লোক তিগ্রস্ত, যারা তাদের সন্তানদের নির্বুদ্ধিতার দরুন ও অজ্ঞতাবশত হত্যা করে’ (সূরা আনয়াম :১৪০)। কন্যাসন্তান জীবন্ত মাটিতে পুঁতে ফেলাকে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড বলে ঘোষণা করে মহানবী সা: পরকালে এর জন্য জবাবদিহির অনুভূতি সৃষ্টি করেন এবং কন্যাসন্তান হত্যাকে চরম গুনাহের কাজ বলে ঘোষণা করেন। কুরআনের ভাষায়, ‘যখন জীবন্ত সমাধিস্থ মেয়েকে জিজ্ঞাসা করা হবে, কী অপরাধে তাকে হত্যা করা হয়েছিল?’ (সূরা তাকভির : ৮-৯)। 
মহানবী সা: এ জঘন্য প্রথা রোধে ঘোষণা করেন, সর্বাপো বড় চারটি গুনাহের একটি হলো সন্তান হত্যা করা’ (সহীহ বুখারি)।
এভাবেই মহানবী সা: কন্যাসন্তান হত্যা রোধে সফল হতে পেরেছিলেন।
কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠকে কুলণ মনে করা নিষিদ্ধকরণ : প্রাগৈতিহাসিক যুগে জন্ম নেয়া কন্যাসন্তানকে অলণে ও দুর্ভাগ্যের প্রতীক মনে করা হতো। তাই কাউকে কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সংবাদ প্রদান করলে তার চেহারা কালো বিবর্ণ করা হয়ে যেত। যার ফলে তারা সন্তানকে জীবন্ত হত্যা করতেও কুণ্ঠাবোধ করত না। মহানবী সা: এ পথকে চিরতরে বন্ধ করলেন। এ প্রথার নিন্দা জানিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তাদের কাউকে যখন কন্যাসন্তান জন্মের সুসংবাদ দেয়া হয়, তখন তার মুখমণ্ডল কালো হয়ে যায় এবং অসহ্য মনঃকষ্টে পতিত হয়। তাকে (কন্যাসন্তান হওয়ার) যে সুসংবাদ দেয়া হয়, তার লজ্জায় সে নিজের দলের লোকেদের কাছ থেকে পালিয়ে বেড়ায়। সে চিন্তা করে, লজ্জার কারণ হওয়া সত্ত্বেও সে তার কন্যাসন্তানকে বাঁচিয়ে রাখবে, নাকি মাটিতে পুঁতে ফেলবে! জেনে রেখ! তারা কতই না মন্দ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে’ (সূরা নাহ্ল  : ৫৮-৫৯)। 
আয়াত দু’টিতে কন্যাসন্তানসংক্রান্ত এ ধারণাকে নিকৃষ্ট বর্ণনা করে এ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। 
কন্যাসন্তান প্রতিপালনের সৌভাগ্য : কন্যাসন্তানের লালন-পালনে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে মহানবী সা: বলেছেন, ‘যখন কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হয় তখন মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের প্রেরণ করেন। তারা এসে বলেÑ পরিবারের সবার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর তারা তাদের বাহু দিয়ে কন্যাসন্তানকে আবেষ্টন করেন এবং তার মাথায় হাত রেখে বলেন, এক অবলা থেকে আরেক অবলা বের হয়েছে। যে ব্যক্তি এর রণাবেণে মনোযোগী হবে সে কিয়ামত পর্যন্ত সাহায্য পাবে’ (আল মুয়াজ্জামুস সাগির লিত তিবরানি)। মহানবী সা: আরো বলেছেন, ‘কারো কন্যাসন্তান ভূমিষ্ঠ হলে সে যদি তাকে পুঁতে না ফেলে, তাকে যদি সে অপমানিত না করে এবং তাকে উপো করে যদি সে পুত্রসন্তানের পপাতিত্ব না করে, তাহলে মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন’ (আবু দাঊদ শরিফ)। অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি দুটো মেয়েকে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত যথাযথভাবে লালন-পালন করবে কিয়ামতের দিন সে ও আমি এভাবে আসব। এ কথা বলে মহানবী সা: তাঁর আঙুলগুলো মিশিয়ে দেখালেন’ (অর্থাৎ মহানবী সা:-এর সাথে তার হাশর হবে) (সহীহ মুসলিম)।
যে মায়ের জন্য জান্নাত : হজরত আয়েশা রা: বলেন, একবার এক মহিলা তার দু’টি মেয়েকে নিয়ে আমার কাছে ভিা চাইল। তখন আমার কাছে একটি খেজুর ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আমি তাকে ওই খেজুরটিই দান করলাম। সে ওই খেজুরটি নিয়ে তার দুই মেয়ের মধ্যে (সমানভাগে) ভাগ করে দিলো এবং সে এর থেকে কিছুই গ্রহণ করল না। তার পর সে মেয়ে দু’টিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। অতঃপর মহানবী সা: আমার কাছে আগমন করলে আমি তাঁকে এ ঘটনাটি অবহিত করলাম। তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি মেয়েদের লালন-পালন, শিা ও বিয়ে দেয়ার ঝামেলায় পড়ল এবং তাদের প্রতি তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করলÑ কিয়ামতের দিন এ মেয়েরা তার জন্য দোজখের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। (অর্থাৎ সে জান্নাতি হবে)’ (মুসলিম শরিফ)।  
সৌভাগ্যবান মা-বাবা : কন্যাসন্তানের মা-বাবা ও অভিভাবককে সৌভাগ্যবান ঘোষণা দিয়ে মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তিনটি কন্যাসন্তান কিংবা অনুরূপ তিনটি বোনকে লালনপালন করেছে, শিষ্টাচার শিা দিয়েছে এবং স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত এদের সাথে সদয় ব্যবহার করেছে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব করে দেবেন। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! যদি কেহ দু’জনকে গ্রহণ করে? মহানবী সা: বললেন, দু’জনকে করলেও তাই হবে। ইবনে আব্বাস রা: বলেন, লোকটি এক মেয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেও মহানবী সা: অনুরূপ জবাবই দিতেন’ (আল-আদাবুল মুফরাদ)।
অসহায় মেয়ের ব্যয়ভার বহন : অসহায় কন্যাসন্তানের দেখাশোনা ও প্রয়োজনীয় ব্যয় বহন করাকে উত্তম সদকা আখ্যা দিয়ে মহানবী সা: বলেছেন, ‘আমি কি বলব তোমাদেরকে কোনটি উত্তম সদকা? শোনো, সেটা হচ্ছে, তোমার সেই মেয়েটির জন্য দান, যাকে স্বামীগৃহ থেকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে আর তুমি ছাড়া তার জন্য রোজগার করার কেউ নেই’ (সহিহ বুখারি)।
এর অর্থ প্রকৃতপে সে মেয়ে, বিয়ে হওয়ার পর যাকে ফের তার মা-বাবার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এটি তার স্বামীর মৃত্যুর কারণেও হতে পারে অথবা তালাক দেয়ার কারণেও হতে পারে। আবার এ হাদিসের অর্থ সে মেয়েও হতে পারে যার বিয়ে হয়নি অথবা বিয়ের যোগ্য নয়। 
শেষ কথা : ইসলামপ্রদত্ত মেয়েশিশুর আর্থসামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ন্যায়ানুগ, ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতার নিরিখে যথার্থ। এর বেশি বা কম করা হলে তা মানবতা, মানব প্রজন্ম এবং স্বয়ং কন্যাসন্তানের জন্য অকল্যাণকর ও তিকর হতো। মহামানব মহানবী সা: কন্যাসন্তানের উন্নয়নে যে অবদান রেখে গেছেন, তা সর্বকালের, সর্বযুগের সব মানব জাতির জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হয়ে থাকবে চিরকাল।