লোকনিন্দা ও অপবাদের পরোয়া করে না মুসলমান

লোকে কী বলবে? তারা কি এটা মেনে নেবে বা অনুমোদন করবে? তারা পরিহার করবে না-তো? এজাতীয় প্রশ্ন আমাদের সব কাজে প্রভাব বিস্তার করে বসে; বিশেষ করে সে কাজের সঙ্গে যদি জনগণের কোনোরূপ সংশ্লিষ্টতা থাকে। সামাজিক চাপ একটা বড় শক্তি, যা আমাদের মনে এই শঙ্কা জাগিয়ে তোলে যে, আমরা যেন অপমানিত না হই, সমালোচনা অথবা বিদ্রূপের শিকার না হই।
একটি সত্ সমাজে এটা ভালো ও ইতিবাচক উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে; কারণ এখানে খারাপ-ভালোর প্রশ্নের চেয়েও দুর্নামের ভয় এড়িয়ে চলার একটা তাগিদ সক্রিয় থাকে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে অন্য একটি প্রতিক্রিয়াও জেগে ওঠে, যা অপশক্তির সহায়ক; কারণ দুর্নামের ভয়ে মানুষ এমন সব কাজ করতে বাধ্য হয়, যাকে সে অনুচিত বলে মনে করে এবং উচিত জেনেও অনেক কাজ থেকে সে বিরত থাকে। ভালো-মন্দ বা উচিত-অনুচিতের প্রশ্নটি শেষ পর্যন্ত অপশক্তির প্রভাবে গ্রহণযোগ্য কি গ্রহণযোগ্য নয়, এটাই মুখ্য হয়ে ওঠে।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয়টি আমরা সহজেই শনাক্ত করতে পারি।
উদাহরণস্বরূপ, পাশ্চাত্যে আজ সব পিতা-মাতার কাছেই উঠতি-বয়সী (ঞববহধমবত্ং) সন্তানদের নিয়ে যে উদ্বেগ তা রীতিমত অপ্রতিরোধ্য। আর শুধু পারিপার্শ্বিক চাপের কারণেই ছেলেমেয়েরা আজ নেশা, লাম্পট্য, ব্যভিচার ইত্যাদি নানা প্রকৃতির পাপকর্মে অবাধে জড়িয়ে পড়ছে এবং এভাবে অগণিত জীবন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসের মাত্রাগত তীব্রতার কারণে আমরা উদ্বিগ্ন হই বটে, কিন্তু সমাজের স্তরে যে সাধারণ প্রবণতা তার কোনো পরিবর্তন ঘটে না। বহু ক্ষেত্রেই বহু মুসলিম পিতামাতা আন্তরিকভাবে উদ্বিগ্ন, কিন্তু ছেলেমেয়েদের অসঙ্গত চাপের কাছে তারা নতি স্বীকারে বাধ্য হচ্ছে।
এবং এই সমস্যা শুধু পশ্চিমা বিশ্বেই সীমাবদ্ধ নয়। দুর্ভাগ্যবশত, অধিকাংশ মুসলিম দেশই আজ এই ভুল ও অসঙ্গতির দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। সেখানে অনৈসলামিক প্রথা, নব নব বিষয়ের উদ্ভাবন (বিদআত) এবং সরাসরি অপরাধকর্ম সামাজিক চাপের কারণে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই চাপের অত্যন্ত প্রিয় ও সরাসরি লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামের প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আঘাত করা। আর এ কারণেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, অনেক মুসলিম দেশে দাড়ি রাখা বা মেয়েদের জন্য হিজাব ব্যবহারকে এমন প্রকাশ্যে নিন্দা ও উপহাস করা হচ্চে, যেন এসব শাস্তিযোগ্য অপরাধ। (মিসরে এই ধরনের ইসলামী ক্রিয়াকর্ম সিক্রেট এজেন্সি দ্বারা গোপনে তদন্ত পর্যন্ত করা হয়; যাই হোক, সে অন্য কাহিনী)। এই আন্-ইসলামিক (টহরংষধসরপ) তত্পরতাকে যারা দৃঢ়তার সঙ্গে মোকাবিলা করতে বদ্ধপরিকর, তাদের চিহ্নিত করা হয় ঋধহধঃরপ অর্থাত্ ধর্মোন্মাদ রূপে।
বস্তুতপক্ষে, এর মধ্যে নতুনত্ব বা অভিনবত্ব কিছু নেই। এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণের সংঘর্ষের মতোই বহু পুরনো। আল কোরআন বলছে, সব নবী-রাসুলই আপন জনগণ কর্তৃক নিন্দিত ও অপমানিত হয়েছেন; অথচ এই জনগণকে অনন্তকালীন শাস্তি থেকে উদ্ধার করাই ছিল তাদের ব্রত। তাদের মিথ্যাবাদী বলা হয়েছে, জাদুকর বলা হয়েছে, ‘অতি-বড় ধার্মিক’ বলে বিদ্রূপ করা হয়েছে; এবং তাদের (নবী-রাসুল) পরিহাস করা হয়েছে ‘বিকৃতবুদ্ধি উন্মাদ’ বলে।
আল কোরআনে হজরত নূহ (আ.) সম্পর্কে এরকমই বর্ণনা আছে। তিনি যে একটি বিরাট জাহাজ নির্মাণ করলেন, তা দেখে সবাই বলে উঠল যে, তিনি চূড়ান্ত উন্মাদ। কারণ সমুদ্র থেকে হাজার মাইল দূরে এরকম একটি জাহাজ তৈরির চেয়ে বড় আর কী উন্মত্ততা হতে পারে! কোরআন উল্লেখ করছে;
“(পরিকল্পনা মোতাবেক) সে জাহাজ বানাতে শুরু করল। যখনই তার জাতির নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা তার পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করত, তখন (নূহকে (আ.) জাহাজ বানাতে দেখে) তাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে দিত। সে বলল, (আজ) ‘তোমরা যদি আমাদের উপহাস করো, (মনে রেখো) যেভাবে তোমরা আজ উপহাস করছো, পরে আমরাও একইভাবে তোমাদের উপহাস করব।” (সূরা হুদ—আ: ৩৮)।
হজরত নূহকে (আ.) তারা বহুদিন ধরে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করে আসছিল। তারা বুঝতেই পারেনি যে, অতি শিগগিরই বন্যা এসে তাদের অজ্ঞতা ও নিশ্চিত ধারণাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। যে কেউই অনুমান করতে পারে, যখন চূড়ান্ত ফয়সালা এসে গেল, কেমন ছিল তাদের ভয়ার্ত অবস্থা। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের বিভ্রমজনিত হাস্য-পরিহাসের মাত্রা স্পর্শ না করে, ততক্ষণ এই বিভীষিকা অব্যাহত ছিল।
সত্য এবং মিথ্যার সংগ্রাম এরকমই। সত্য স্বাভাবিক নিয়মেই জয়লাভ করবে। কিন্তু তার আগে সত্যকে নিয়ে মিথ্যা কিছুটা তামাশা ও হাস্যরস সৃষ্টির অবকাশ পায়। আর এজন্যই সত্য দূরদর্শী, ধৈর্যশীল, সাহসী ও দৃঢ়চিত্ত মানুষদেরই আকর্ষণ করে। যেহেতু চূড়ান্ত ফলাফলের দিকে তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে, অনিবার্যভাবে আগত অপমান ও অসম্মান ও মিথ্যা প্রচার তাদের সামনে বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে পারে না। এবং এজন্যই আল কোরআন উল্লেখ করে, আল্লাহপাক যাদের ভালোবাসেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালোবাসে, সেই ঈমানদারদের অন্যতম গুণ হলো, ‘তারা কোনো নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় পায় না’ (সূরা মায়িদাহ-আ: ৫৪)।
অবশ্য এটাই অবশ্যম্ভাবী; কারণ আমাদের নিশ্চিতভাবে উপলব্ধি করা উচিত যে, অনন্তদিনের ধ্বংসকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়ে যারা মিথ্যার ওপর নির্বিকার দাঁড়িয়ে আছে, সেসব দুর্ভাগা মানুষের নিন্দা ও পরিহাসের ভয়ে সত্য ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার চেয়ে অধিক হাস্যকর আর কী হতে পারে! লোকনিন্দার ভয়ে সত্যকে মিথ্যার কাছে বিক্রি করে দেয়াই তো সর্বাপেক্ষা অধিক নিন্দনীয় এবং সর্বাধিক উপহাসের বস্তু। লোকে উন্মাদ বলবে, এ ভয়ে জেনেশুনে আল্লাহপাকের অবাধ্য হওয়ার চেয়ে বড় আর কী বিভ্রম ও উন্মত্ততা হতে পারে!
কোরআন আমাদের দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিচ্ছে এবং ইতিহাসও একই সাক্ষ্য বহন করে, এটা কোনো সঠিক লক্ষ্য বা পথ নয় যে, ঈমানদার নরনারী সত্যকে আশ্রয় করে জীবনপথে অগ্রসর হবে, অথচ তাকে কোনো বিদ্রূপ ও তামাশা-পরিহাস স্পর্শ করবে না। দুর্ভাগ্যবশত এবং জ্ঞানত, অদ্যকার এই বিশাল প্রচার-প্রপাগান্ডার প্রেক্ষাপটে আমরা এরকমই আশা করি এবং এরকমই দেখতে পাই। আসলে নিন্দুকদের হাস্য-পরিহাস যখন খুবই জোরালো হয়ে ওঠে, তখন আমাদের উচিত হজরত নূহের (আ.) সমসাময়িক সেই পরিহাসপ্রিয় জননেতাদের কথা স্মরণ করা, যারা একদিন কৌতুক-হাস্যে পড়ত। কিন্তু শেষ হাসিটি কার ছিল?
“অবশ্যই তারা ভীষণ অপরাধী, যারা ঈমানদারদের সঙ্গে বিদ্রূপ করেছে। তারা যখন এদের পাশ দিয়ে যাতায়াত করত, তখন তারা তামাশাভরে পরস্পর চোখ টেপাটেপি করত এবং যখন তারা নিজেদের লোকদের কাছে ফিরে যেত, তখন খুব উত্ফুল্ল হয়েই ফিরত। আর যখন তাদের দেখত, তখন একে অপরকে বলত, ‘এরা হচ্ছে কতিপয় পথভ্রষ্ট ব্যক্তি’। অথচ তাদের এই (মুমিন) ব্যক্তিদের ওপর তত্ত্বাবধায়ক করে পাঠানো হয়নি। (বিচারের পর) আজ ঈমানদার ব্যক্তিরাই কাফেরদের ওপর (পতিত আজাব দেখে) হাসবে” (সূরা মুতাফিফফীন আ: ২৯-৩৪)।