‘মুমিন’ ও ‘মুসলিম’ শব্দ দু’টি আমাদের অতি পরিচিত। শব্দ দু’টিকে আমরা সব সময় ব্যবহার করে থাকি, নিজের বা অন্যের জন্য। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বুঝে-না-বুঝে আমরা নির্বিচারে এ শব্দ দু’টিকে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। সমাজসংসারে চলতে এমন ঘটনা আমাদের মাধ্যমে অহরহ ঘটে চলেছে। ফলে অনেক অর্থবহ শব্দ বা বিষয়ের ব্যবহার করতে গিয়ে অবলীলায় অপব্যবহার বা অসদ্ব্যবহার করাটা আমাদের সমাজে এখন গা সওয়া একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাক সে কথা, অনেকে এ দু’টিকে সমার্থক মনে করে থাকেন। আসলে তা নয়; এরা একে অন্যের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। সহজ কথায়, ‘মুমিন’ মানে বিশ্বাসী। অর্থাৎ যিনি আল্লাহর একত্বে ঈমান এনেছেন। আর ঈমানের অপর অর্থ দৃষ্টিভঙ্গি। অপর দিকে, ‘মুসলিম’ মানে অনুগত। ইসলামি বিধান মতে, আল্লাহতে বিশ্বাসী মানুষকে মুমিন বলা হয়। আর ইসলামের যাবতীয় বিধানের কাছে অনুগত বা আনুগত্য প্রকাশকারীকে ‘মুসলিম’ বলা হয়।
‘মুসলিম’ হতে হলে আগে ‘মুমিন’ হতে হয় এবং সে মতে, ইসলামের বিধানকে একনিষ্ঠভাবে পরিপালনের মাধ্যমে তা প্রমাণিত ও অর্থবহ হয়ে থাকে। আর কর্মহীনভাবে কেউ আল্লাহকে একক সত্তা এবং রাসূলুল্লাহ সা:কে তাঁর রাসূল বলে ঘোষণা দিয়ে ‘মুমিন’ হিসেবে আদমশুমারির তালিকায় থাকতে সক্ষম হবেন। কিন্তু বাস্তবে এ ধরনের বিশ্বাস পোষণে ব্যক্তির দুনিয়া বা আখিরাতের জীবনে কোনো সুফল বয়ে আনবে না। কারণ কর্মহীন বিশ্বাসকে প্রকারান্তরে অর্থহীন একটি অবস্থানকে বলা হয়ে থাকে। সেটা কখনোই কোনো মানুষকে কোনো ধরনের কল্যাণ দিতে পারে না। যেমন কোনো চিকিৎসকের দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রতি অপরিসীম বিশ্বাস ও ভক্তি রেখে তার চিকিৎসাপত্র না মানলে রোগ নিরাময় যেমন সম্ভব হয় না, তেমনি আল্লাহ ও তাঁর বিধানের প্রতি কর্মহীন বিশ্বাসের ঘোষণা একজন মানুষকে কোনোভাবেই কল্যাণ নিশ্চিত করবে না। তবে আমরা ওই ব্যক্তিকে ‘মুমিন’ বললেও সে ব্যক্তিজীবনে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমাদের সমাজজীবন এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। যুক্তির কথা এই যে, মুসলিম মানে আল্লাহর বিধানের কাছে সম্পূর্ণভাবে সমর্পিত একজন শান্তিকামী ব্যক্তি; বিশ্বমানবতার কল্যাণসাধনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কিন্তু বাস্তবে কি আমরা সে রূপ হতে পেরেছি ব্যক্তি কিংবা সামষ্টিক জীবনে। একই যুক্তি বলে, পৃথিবীর মুসলিম অধ্যুষিত মানববসতিগুলো শান্তিময় হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। কারণ বেশির ভাগ মুসলমানেরা আজ কর্মহীন বিশ্বাসী। অথচ ইসলামি জীবনবিধানের অন্যতম একটি দিক বিশ্বাস স্থাপন করা আর অপরটি মেনে চলা। বিশ্বাস ও কর্মের সমন্বয়েই ইসলাম। কেবল জানার নাম যেমন ইসলাম নয়; আবার বিশ্বাসহীনভাবে মেনে চলাও ইসলামে গ্রাহ্য নয়। বিশ্বাস ও কর্ম একে অন্যের পরিপূরক। কুরআনের ভাষায় মুসলিম না হয়ে মৃত্যুবরণ করতে নিষেধ করা হয়েছে এভাবে ‘আর এরই উপদেশ দিয়েছেন ইবরাহিম তার সন্তানদেরকে এবং ইয়াকুবও (যে) ‘হে আমার সন্তানেরা, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীনকে চয়ন করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলিম হওয়া ছাড়া মারা যেয়ো না’ (সূরা বাকারা : ১৩২)।
আমরা জানি, কোনো জিনিস বা সত্তাকে না দেখে তার অস্তিত্বকে সত্য বলে মেনে নেয়াকে বিশ্বাস বলে; যেমনভাবে তা দেখে মেনে নেয়া হয়ে থাকে। যেমন কুরআন ও সুন্নায় বলা হয়েছে, এমন গুণাবলিসহ আল্লাহ তায়ালার একত্ববাদে বিশ্বাস করা, আখিরাতে বিশ্বাস করা, তকদিরে বিশ্বাস করা ইত্যাদি। আর কোনো জিনিস বা বস্তুকে দেখে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করাকে বলে সাক্ষ্য দেয়া। যেমনÑ রাসূলুল্লাহ সা:এর প্রতি ও তাঁর রিসালাতের প্রতি বিশ্বাস ও সাক্ষ্য প্রদান করা। এগুলো ঈমানের অপরিহার্য অঙ্গ। ইচ্ছাকৃতভাবে এর কোনোরূপ ব্যতিক্রম করলে তার ঈমান থাকবে না। ইসলামে দু’টি বিষয়ই রয়েছে, কিছু বিশ্বাসের আর কিছু সাক্ষ্যপ্রদানের। এ দুইয়ের সমন্বয়েই ইসলাম। তবে তা অবশ্যই রাসূলুল্লাহ সা:-এর দেখানো পথ ও পদ্ধতিতে হতে হবে। সব সময় দূরে থাকতে হবে সব ধরনের ভ্রান্তবিশ্বাস ও ধারণা থেকে। কারণ অনেক ভ্রান্তবিশ্বাস ও ধারণা আমাদেরকে শিরক ও কুফরির পথে নিয়ে যায়। একজন মুমিন বিশ্বাসী হবে আল্লাহর প্রতি, আর শর্তহীনভাবে অনুগত হবে তাঁর আদেশ-নিষেধের প্রতি।
ইসলাম মানবতাকে সর্বপ্রথম তাওহিদের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য আহ্বান করেছে। কেননা মানুষ যা বিশ্বাস করে সে অনুযায়ীই চিন্তা করে। আর যা চিন্তা করে সে অনুযায়ী সে কাজ করতে চেষ্টা করে থাকে। এখানে বিশ্বাসই মূল জিনিস হিসেবে বিবেচিত। বিশ্বাসের মর্মমূলে কোনো দুর্বলতা থাকলে তা অনিবার্যভাবেই চিন্তায় ভেসে উঠবে, আর তার প্রতিফলন দেখা যাবে কর্মে। মানুষের চিন্তাকে বলা হয় তার কর্মের কলি। কর্মকে বিশুদ্ধ ও শুচিশুদ্ধ করতে ওপরের দিকে বিশ্বাসের জগতে নাড়া দিতে হবে। আর একইভাবে মানুষের কাজকে সুন্দর ও কল্যাণবহ করতে হলে তার চিন্তার পরিশুদ্ধি বা পবিত্রতা আনতে হবে। একজন মানুষের মনে পবিত্র চিন্তা তখনই আসা সম্ভব, যখন তার বিশ্বাস হবে নিষ্কলুষ, পূতপবিত্র। তাই ইসলাম মানবতাকে পরম পবিত্র এক মহান সত্তা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনয়নের জন্য আহ্বান করেছে। তিনি যেমন পূতপবিত্র, তাঁর প্রতি তেমনি পবিত্রতা নিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। কাউকে কোনো প্রকারে তাঁর সাথে শরিক করা যাবে না। তাই একজন মানুষের কাছে ইসলামের আহ্বান সে শিরক ও নিফাকের কলুষমুক্ত বিশ্বাস আনয়ন করবে আল্লাহর প্রতি। আর সে তার বিশ্বাসবোধের পবিত্র অবস্থান থেকেই চিন্তা করবে এবং বাস্তবকর্মে সাক্ষ্য দেবে নিজেকে ইসলামের একজন অনুসারী হিসেবে। তবেই সে মুসলিম হিসেবে স্বীকৃত হবে।
ওপরে আলোচনা নিশ্চয় আমাদের কাছে ইসলামের ‘মুমিন’ ও ‘মুসলিম’ পরিভাষাকে স্পষ্ট করেছে। এখন এ অর্থে আমাদের অবস্থান কোথায় তা নির্ণয় করা মোটেই কঠিন হওয়ার কথা নয়। কারণ মানুষ নিজের জীবন সম্পর্কে অন্যের চেয়ে বেশি জানে। এমনই এক ঘটনা জানা যায় হাসান বসরি রহ:-এর জীবনী থেকে। এক দিন এক লোক তার কাছে এসে জানতে চাইলেন, হুজুর আমি কতটুকু ভালো? তিনি সবিনয়ে উত্তর দিলেন, বাবা! তোমার (ব্যক্তি) জীবনের ভালোমন্দের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার পরে এ পৃথিবীর বুকে তুমিই সবচেয়ে ভালো জানবে বিধায় তুমি একটু ভেবে দেখো, তুমি কতটুকু ভালো বা মন্দ। কথাটির সূত্র আমার কাছে না থাকলেও যৌক্তিকতা অনস্বীকার্য। এখন প্রয়োজন কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে নিজের জীবনকর্মকে মিলিয়ে নেয়া, আমি কি কর্মহীন ‘মুমিন’ হয়ে মুসলিম হওয়ার দাবিদার না অর্থপূর্ণ ‘মুসলিম’ জীবনের অধিকারী। আমাদের প্রত্যেককেই দৃঢ়ভাবে মনে রাখা জরুরি যে, দুনিয়াতে আমার পরিচয় বা পরিতৃপ্তি যথেষ্ট নয়; আখিরাতে আমাকে আমার আমলনামা বা কর্মকাণ্ডের একটি নিখুঁত তালিকা তুলে দেয়া হবেÑ যার কোনো কিছুই অস্বীকার করা যাবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছেন, ‘পাঠ করো তোমার কিতাব, আজ তুমি নিজেই তোমার হিসাব-নিকাশকারী হিসেবে যথেষ্ট’ (সূরা বনি ইসরাইল : ১৪)।
হাশরের ময়দানে বিচারকালে মানুষের দুনিয়ার জীবনের কাজের বিবরণ মুখে বলার প্রয়োজন হবে না। মানুষের প্রত্যেক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সাক্ষ্য দেবে সে কী করেছে, কিভাবে করেছে। এ বিষয় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে কুরআন তুলে ধরেছে ‘আজ আমি তাদের মুখে মোহর মেরে দেবো এবং তাদের হাত আমার সাথে কথা বলবে ও তাদের পা সে সম্পর্কে স্যা দেবে যা তারা অর্জন করত’ (সূরা ইয়াসিন : ৬৫)।
মানুষের জন্য বাকচাতুর্যে দুনিয়ার জীবনে নিজেকে মুমিন বা মুসলিম দাবি করা ও তার প্রমাণ হাজির করা সহজ হলেও আখিরাতে তা হবে চূড়ান্ত বাস্তবসম্মত। সেখানে সব প্রতিদান হবে ন্যায়সম্মতভাবে। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সবার প্রতি ইনসাফ নিশ্চিত করা হবে। আর ইনসাফ করা বলতে প্রত্যেককে তার যথার্থ পাওনা বুঝিয়ে দেয়া, কোনোভাবে কম-বেশি না করা। অলীক স্বপ্ন দুনিয়ায় যেমন কোনো ফল বয়ে আনে না, তেমনি দুনিয়ার জীবনের পল-অনুপলে ইসলামি অনুশাসনকে অবজ্ঞা করে আখিরাতে মুক্তির প্রত্যাশাও হবে হাস্যকর ও অপমানজনক পরিণতির নামান্তর।
তাই একজন সচেতন মানুষ হিসেবে আমরা কর্মশূন্য বিশ্বাস নিয়ে সন্তুষ্ট না থেকে ইসলামের সুমহান আদর্শকে নবীর দেখানো পথে পরিপালন করার মধ্য দিয়ে অনুগত বান্দা বা মুসলিম হিসেবে জীবননির্বাহে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবো এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা। এমনই এক চেতনাবোধ থেকে আমাদের জাতীয় কবি বলেছেন ‘তোমার বাণীরে করিনি গ্রহণ ক্ষমা কর হজরত, ভুলিয়া গিয়াছি তব আদর্শ, তোমার দেখানো পথ।’