হিংসা মানুষের অন্তরের দুরারোগ্য ব্যাধি, যা সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করে সমাজে নানা ফেতনা ফাসাদ সৃষ্টি করে। সর্বোপরি তা সমাজের সম্প্রীতির ভীত নষ্ট করে দেয়। হিংসা-বিদ্বেষের ফলে মানুষ কারো বিরুদ্ধে কুচক্রান্ত, ষড়যন্ত্র এমনকি সম্পর্কচ্ছেদ করতেও দ্বিধা করে না। তাই যতক্ষণ মানুষের অন্তর বিদ্বেষমুক্ত না হয় ততক্ষণ তার কর্মও অন্যায়মুক্ত হয় না।
হিংসা-বিদ্বেষ সমাজে অন্যায়-অপকর্ম ও পাপাচার ছড়ায়। হিংসার কারণে সমাজের মানুষ অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। সর্বপ্রথম পাপ করে ইবলিস। সেটা ছিল হিংসার কারণে। ইবলিসকে বলা হলো আদম আ:-কে সম্মানের সিজদা দিতে। আদম আ:-এর উচ্চমর্যাদা দেখে ইবলিস হিংসায় জ্বলে ওঠে এবং তাকে সিজদা করতে অস্বীকার করে। ফলে সে জান্নাত থেকে চিরদিনের জন্য বিতাড়িত হয়।
অনুরূপভাবে আদমপুত্র কাবিল তার ভাই হাবিলকে হত্যা করে হিংসার বশবর্তী হয়ে। হাবিল ছিল পরহেজগার ও মুত্তাকি। সে আল্লাহর ভালোবাসায় তার সবচেয়ে ভালো দুম্বাটি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে। কাবিল তার ক্ষেতের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ফসলের একটা অংশ আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি দেয়। আল্লাহ তায়ালা কাবিলের কোরবানি কবুল না করে হাবিলের কোরবানি কবুল করেন এবং আসমান থেকে আগুন এসে তা উঠিয়ে নেয়। এতে কাবিল হিংসায় জ্বলে ওঠে এবং হাবিলকে হত্যা করে।
পরবর্তীকালে ইহুদিরা বিদ্বেষী হয়ে ওঠে মুসলমানদের ওপর এ হিংসায় যে, শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ সা: কেন মুসলমানদের মধ্যে আগমন করল। তাদের ধারণা ছিল, শেষ নবী তাদের মধ্য থেকে আগমন করবে। শেষ নবী তাদের মধ্য থেকে আগমন না করার হিংসায় তারা বহু মুসলমানকে ঈমান আনার পরও কাফের বানাতে চেষ্টা করেছে। কুরআন কারিমে বলা হয়েছে, ‘আহলে কিতাবদের অনেকে চায় ঈমান আনার পর তোমাদেরকে কুফরিতে ফিরিয়ে নিতে, তাদের নিকট সত্য প্রকাশ হওয়ার পরও, শুধু বিদ্বেষবশত তারা এ অপকর্ম করে’ (সূরা বাকারা : ১০৯)।
দেখা যাচ্ছে যুগে যুগে মানুষ হিংসার কারণেই অপরাধপ্রবণ হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ কর না, ষড়যন্ত্র কর না ও সম্পর্ক ছিন্ন কর না। বরং তোমরা আল্লাহ তায়ালার বান্দা হিসেবে পরস্পর ভাই ভাই হয়ে যাও।’
হিংসা-বিদ্বেষ মুনাফিকের চরিত্র। কোনো মুমিন অন্য মুমিনের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ রাখতে পারে না। এটি মুনাফিকদের একটি বদ স্বভাব। মুনাফিকদের হিংসা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যদি তোমাদের কোনো কল্যাণ স্পর্শ করে তাতে তারা অসন্তুষ্ট হয় আর যদি তোমাদের কোনো অকল্যাণ হয় তাতে তারা আনন্দিত হয়’ (সূরা আলে ইমরান : ১২০)। এই দু’টি স্বভাবের মধ্যে মুমিনের গুণ হলো সে সর্বদা মানুষের কল্যাণ চাইবে, শুভ কামনা করবে। অন্যের অকল্যাণ কামনা করে কখনো মুমিন হওয়া যায় না।
হাদিস শরিফে আছে, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অন্যের জন্য সেই বস্তুই ভালো না বাসবে যে বস্তু সে নিজের জন্য ভালোবাসে।’ কারণ মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই। সূরা হুজরাতের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই’। আর সত্যিকার অর্থে ভাই ভাইয়ের জন্য এমন বস্তু কামনা করতে পারে না যা সে নিজের জন্য অপছন্দ করে। অপর দিকে মুনাফিকের স্বভাব হলো, সে সর্বদা অন্যের অকল্যাণ চায়। অন্যের কোনো ভালাই দেখলেই সে অস্বস্তি বোধ করে। আর এটাকেই হাদিসের পরিভাষায় হিংসা বলা হয়েছে।
‘আল্লাহ তায়ালা অন্যকে যে নেয়ামত দান করেছেন তার প্রতি হিংসা করা এবং ওই নেয়ামতের ধ্বংস কমনা করা’ এরই নাম হাসাদ বা হিংসা। সুতরাং বোঝা গেল হিংসার সাথে নেফাকের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। হিংসার সবচেয়ে বড় শাস্তি হলো, হিংসুক ক্রমান্বয়ে মুনাফিক হয়ে যায়। আর মুনাফিকদের অবস্থান হবে জাহান্নামের সর্বনি¤œ স্তরে। কুরআন কারিমে বলা হয়েছে, ‘মুনাফিকদের অবস্থান হবে জাহান্নামের সর্বনি¤œ স্তরে এবং তাদের জন্য কোনো সাহায্যকারী পাওয়া যাবে না’ (সূরা নিসা : ১৪৫)।
সুতরাং প্রকৃত মুমিন কখনো কারো প্রতি হিংসা বিদ্বেষ পোষণ করতে পারে না। বরং মুমিনের হৃদয় থাকবে উদার। সে সবাইকে ভালোবাসবে। ব্যক্তিগত কারণে কারো প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করবে না। ভালোবাসা ও বিদ্বেষের মানদণ্ড হলো ঈমান। যার মাঝে ঈমান আছে তাকে ভালোবাসবে। যার মাঝে ঈমান নেই তার সাথে সামাজিক সৌজন্য বজায় রাখলেও তাকে ভালোবাসা যাবে না।
হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যে আল্লাহ তায়ালার জন্য অপরকে ভালোবাসে আল্লাহ তায়ালার জন্য বিদ্বেষ করে, আল্লাহ তায়ালার জন্য দান করে এবং তার জন্য বিরত থাকে সেই পূর্ণ মুমিন।’ অন্য হাদিসে আছে, একবার রাসূলুল্লাহ সা:-কে জিজ্ঞেস করা হলো, শেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি বললেন, ‘প্রত্যেক শুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী এবং সত্যভাষী।’ লোকেরা বলল, সত্যভাষীকে তো আমরা চিনতে পারি, কিন্তু শুদ্ধ হৃদয়ের ব্যক্তিকে আমরা কিভাবে চিনব?’
রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘যার মাঝে আল্লাহ ভীতি থাকবে, যার হৃদয় হবে পরিচ্ছন্ন, যাতে থাকবে না পাপ-পঙ্কিলতা এবং হিংসা-বিদ্বেষ।’ সুতরাং হিংসার মতো মানবতাবিধ্বংসী, সমাজবিধ্বংসী ব্যাধি থেকে আমাদের সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে।