মৃত্যুর স্বাদ সবাইকে নিতে হবে

আজ আমরা দুনিয়া উপার্জনের জন্য ছোটাছুটি করছি, আমাদের বিরতিহীন চেষ্টা-সাধনা, দৌড়ঝাঁপ, দিনরাতের পরিশ্রম সব কিছুই এই দুনিয়ার সুখের জন্য। এ জন্য আমাদের প্রচেষ্টা হলো আমার বাসস্থান ভালো হোক, আমার অর্থোপার্জন হোক, দুনিয়ায় আমার সম্মান অর্জিত হোক, সমাজে আমার সুনাম-সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়–ক, আমি খুব ভাগ্যবান হয়ে যাই এবং আমার উঁচু মর্যাদা হাসিল হোক। মোটকথা এ পার্থিব জীবনের সুখশান্তিই হলো আমাদের যাবতীয় চিন্তাচেতনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু আমরা কখনো চিন্তা করে দেখিনি যে, যে কারণে এসব দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছি ছোটাছুটি করছি, যে আশায় হালাল ও হারামকে একাকার করে রেখেছি, যার ফলে ঝগড়াবিবাদ লোগেই রয়েছে এবং যে কারণে মানুষ একে অপরের রক্তপিপাসু হয়ে ওঠে, সেই জীবনটি কত দিনের?
আর মৃত্যুর পর যে জীবন আসন্ন, সেই জীবনটি এ পার্থিব জীবনের মোকাবেলায় কত বেশি কল্যাণকর ও উত্তম! বস্তুত পারলৌকিক জীবন ইহলৌকিক জীবনাপেক্ষা অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী ও সীমাহীন।
এই পৃথিবীর কোনো আনন্দ বা সুখই পরিপূর্ণ নয়।
প্রতিটি সুখ-আনন্দের সাথে দুঃখ-পেরেশানির কাঁটা, কোনো চিন্তা, কোনো আঘাত কিংবা কোনো অস্থিরতার কাঁটা লেগেই রয়েছে। এখানকার কোনো আনন্দ, কোনো স্বাদই পরিপূর্ণ নয়। পৃথিবীর কোনো সুখ-আনন্দই এমন নেই, যা পূর্ণতা লাভ করতে সক্ষম। মানুষ মনে করে, ধনসম্পদ সঞ্চয় করলেই সুখশান্তি লাভ হবে, মনের অস্থিরতা-টেনশন দূর হয়ে মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে। কিন্তু আপনি কিছু বড় ধনকুবের ও শিল্পপতির ব্যক্তিগত জীবনের প্রতি তীè দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন। এতে আপনি দেখতে পাবেন বাহ্যত তাদের অনেক কলকারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, নয়নাভিরাম অট্টালিকা ও জৌলুশপূর্ণ বাংলো আছে। এ ছাড়া উন্নত গাড়ি ও প্রয়োজনীয় ভৃত্য-কর্মচারীসহ সুখ লাভের যাবতীয় উপকরণ তাদের নিকট বিদ্যমান।
অথচ এত কিছু থাকার পরও রাতে তাদের চোখে ঘুম আসে না। ঘুম আসার জন্য তাদেরকে ওষুধ খেতে হয়। আরামের বিছানা ও মশারি রয়েছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ বিদ্যমান বটে; কিন্তু চোখে ঘুম নেই। পক্ষান্তরে একজন দিনমজুর-শ্রমিক, একজন চাষির ব্যক্তিগত জীবনযাপনের প্রতি লক্ষ করুন। যার কাছে কোনো ধরনের মশারি, আরামের বিছানা ও রাজসিংহাসন তো নেই বটে, কিন্তু সারা দিনের কাজ শেষে কান্ত হয়ে ঘরে ফিরে এসে তিনি রাতে মাথার নিচে তাত রেখে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমিয়ে পড়েন। তিনি ৮ ঘণ্টাব্যাপী পুরোপুরি ঘুমিয়ে ওঠেন।
এবার বলুন তো, রাতটা ওই ধনাঢ্য ব্যক্তির ভালো কেটেছে, নাকি ওই দরিদ্র দিনমজুর ও কৃষকের ভালো কেটেছে? অতএব বোঝা গেল, আল্লাহ তায়ালা এ পৃথিবীকে এভাবে সাজিয়েছেন যে, এর কোনো আনন্দ-সুখ ও কোনো স্বাদই পরিপূর্ণ নয়। প্রতি সুখ-আনন্দের সাথেই কোনো না কোনো চিন্তা বা দুঃখ লেগে রয়েছে। আবার প্রত্যেক দুঃখের সাথেও কোনো না কোনো সুখ আছেই।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, পরকালের জীবনই ‘উত্তম’। ‘উত্তম’-এর অর্থ হলো পরিপূর্ণ। সেখানকার স্বাদও পরিপূর্ণ, সেখানকার দয়াও পরিপূর্ণ। সেখানকার সুখ-আনন্দ শুধু পরিপূর্ণই নয়, বরং চিরস্থায়ীও বটে। এ দুনিয়ার ভেতর কোনো একটি বিষয় এতটুকু সুনিশ্চিত নেই, কোনো বিষয়ে এতটুকু ঐকমত্য নেই; যতটুকু সুনিশ্চয়তা ও ঐকমত্য রয়েছে এ বিষয়ের প্রতি যে, প্রত্যেক মানুষকেই একদিন মরতে হবে। আর এটা এতই সুনিশ্চিত বিষয়, যা মুসলমান তো বটেই একজন কাফেরও এ কথাটি স্বীকার করতে বাধ্য যে, হ্যাঁ! অবশ্যই একদিন সে মৃত্যুবরণ করবে।
সৃষ্টিজগতে আজ পর্যন্ত এমন কোনো মানুষ জন্ম নেয়নি যে, অভিমত পেশ করবে, মানুষের মৃত্যু আসবে না। অনেক মানুষ আল্লাহকে অস্বীকার করে বলে ফেলেছে, তারা আল্লাহকে মানে না (নাউজুবিল্লাহ)। কিন্তু মৃত্যুকে অস্বীকারকারী লোক আজ পর্যন্ত সৃষ্টি হয়নি। বড় বড় বস্তুবাদী, পথভ্রষ্ট ও নাস্তিকেরাও এ কথা বলতে পারে না, আমার মৃত্যু আসবে না। বিজ্ঞান অগ্রগতি এনেছে। মানুষ চাঁদের দেশে পৌঁছেছে, মঙ্গলগ্রহে পৌঁছানোর চেষ্টায় আছে। কম্পিউটার আবিষ্কার হয়েছে। রোবট উদ্ভাবিত হয়েছে। প্রায় সব কিছু হয়েছে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জিজ্ঞেস করুন বলুন তো, সামনে বসে থাকা লোকটির মৃত্যু কখন ও কোথায় হবে? সমগ্র বিজ্ঞান, সব বিষয়ের জ্ঞান এখানে এসে ব্যর্থ হয়ে পড়ে। কেউই বলতে পারে না মৃত্যু কখন আসবে? কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, মৃত্যুবরণ করার বিষয়টি যতটুকু নিশ্চিত, আর তার সময় যতটুকু অনিশ্চিত, ওই মৃত্যু থেকে আমরা ঠিক ততটুকুই উদাসীন।
আমরা প্রত্যেকেই নিজের দিকে লক্ষ করলে দেখতে পাবো, ভোরে জাগ্রত হওয়ার পর থেকে শুরু করে রাতে শয্যায় যাওয়া পর্যন্ত সময়ে আমরা কী চিন্তাভাবনা করেছি? আমাদের মনে কী কী কল্পনা এসেছে? বস্তুত আমাদের মনে পার্থিব আয়রোজগার, মেহনত-পারিশ্রমিক, চাকরি, ব্যবসায় বাণিজ্য, চাষাবাদ ইত্যাদি আরো কত বিষয়ের কল্পনা যে এসেছে, সে সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন।
কখনো এমন ভাবনা কি এসেছে যে, আমাকেও একদিন নির্জন কবরে যেতে হবে? অতঃপর কবরে যাওয়ার পর আমার অবস্থা কী হতে পারে? দিনে যে কবরের পাশ দিয়ে হাঁটতে ভয় লাগে, অন্ধকার রাতে সেই কবরে কিভাবে একা থাকব। মানুষের মন ও মস্তিষ্কে যখন মৃত্যুর বিষয়টি বদ্ধমূল হয়ে যায়, তখন সে আর কোনো গুনাহ, কোনো অপরাধ করার কাজে হাত বাড়াতে পারে না। প্রত্যেক মানুষই এ কাজে ব্যস্ত থাকবে, যাতে সে জান্নাতের উপযোগী হতে পারে ও মহান আল্লাহ পাককে সন্তুষ্টকারী হয়ে যায়। আর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন, এমন কাজগুলো থেকে সে বিরত থাকবে।
আমি কত লোককে মৃত্যুবরণ করতে দেখলাম, কবরে সমাহিত হতে দেখলাম; একদিন তো আমার ক্ষেত্রেও এ অবস্থা হবে। আর কবরের ভেতর কী অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে সে ব্যাপারে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সা: বলে দিয়েছেন কবরে কী হবে? কবরের পরবর্তী জীবন কেমন হবে? পুরো কুরআন মজিদ পরকালের আলোচনায় ভরপুর। আর হাদিসগুলোতে প্রিয়নবী সা: পরকালে যা সংঘটিত হবে, সে বিষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। যাতে পরকালের কল্পনা অন্তরে বিস্তার করতে পারে এবং পরকালের ভাবনা অন্তরে গেঁথে যায়। কিন্তু আফসোস!
আমরা ২৪ ঘণ্টায় ওই পরকাল ভাবনার জন্য কোনো সময় বের করতে পারি না। এই পৃথিবীতে একদিন আমরা ছিলাম না, কেউ আমাদের চিনত না, আমরা এসেছি; আবার যেদিন হায়াত নামক ঘড়ির কাঁটা সোজা হয়ে যাবে তখন চিরচেনা সব মানুষের বন্ধন ছিন্ন করে সব স্মৃতি মুছে দিয়ে আমাদের চলে যেতে হবে না ফেরার এক অচিনদেশে। যেখানে যাওয়ার জন্য জন্মের পর থেকেই একটি শিশুকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। আর মৃত্যুই হয় একজন মানুষের শেষ পরিণতি এবং সমাধিই হয় তার শেষ আশ্রয়স্থল। যেখানে পৃথিবীতে যারাই একবার এসেছে, তারাই পাড়ি জমাবে এবং পাড়ি জমানোর সময় একজন সম্রাটও অসহায় হয়ে যায়। এ কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
লেখক : মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী বিশিষ্ট মুফাসসিরে কুরআন ও খতিব, ঢাকা